রণেশ মৈত্র


যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় লিখতে গিয়ে মাননীয় বিচারকবৃন্দ কয়েকবার মন্তব্য করেছেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সন্ত্রাসী দল। বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোন সন্ত্রাসী দলের বৈধভাবে সমাজে কাজ করার অধিকার নেই। ইতোমধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আদালতে প্রমাণিত সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতে ইসলাম আজও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় নি। তারা দিব্যি দেশী-বিদেশী সহায়তায় ও আনুকূলে ও অর্থায়নে দিব্যি প্রকাশ্য ও সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে বহু লেখালেখি হলেও এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত দফায় ফ্রাশিত হলেও বিগত প্রায় ৪টি দশকের মধ্যে দলটিকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয় নি। তাদেরকে এদেশে ঢুকতে দেওয়া বা বাংলাদেশের সদস্য পদ না দেওয়া ও গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামীসহ সকল খুনী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফাঁসি দেওয়ার দাবী তুলেছিলেন মাতৃসমা নেত্রী ও পুত্রহারা শহীদ জননী সেই ২০/২৫ বছর আগেই। কোন নেতা-নেত্রী তাঁর আগে এমন দাবী সাহসের সাথে উত্থাপন করে দেশব্যাপী জমায়েত করেননি। একমাত্র শহীদ জননী জাহানারা ইমামই এই দাবীতে দেশের প্রখ্যাত জনদের নিয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মত দেশের বৃহত্তম ময়দানে গণ-আদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিচারের দুঃসাহসী আয়োজন করেন।

স্বাধীনতা বিরোধীদের তীব্র বিরোধিতার মুখেও লক্ষাধিক মানুষ ঐ গণ আদালত পর্যবেক্ষণে শুধুমাত্র ঢাকা শহরই নয়, দূর-দূরান্ত থেকেও এসে যোগ দেন। বিশাল মঞ্চে উঠেছে চেয়ারে আসন গ্রহণ করেন বিচারকবৃন্দ, থাকেন প্রখ্যাত আইনজীবীবৃন্দ। একে সাক্ষীরা এসে সাক্ষ্য প্রদান করেন। মাননীয় বিচারক বৃন্দ সাক্ষ্য ও জেরার ভিত্তিতে এই মর্মে রায় দেন যে গোলাম আযম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সমূহ দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে সর্বসম্মতিক্রমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলানো উচিত।

যেহেতু ঐ গণ আদালত ছিল নেহায়েতই ছিল জনগণের আদালত-সাংবিধানিকভাবে গঠিত কোন আদালত নয়-তাই তখন সরকারিভাবে ঐ অভিযোগে আমল দেওয়া হয় নি। কিন্তু সর্বত্রই জনগণ বরাবর সোচ্চার আওয়াজ তুলেছেন গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে। আমি নিজেও দীর্ঘদিন আগে (তারিখ মনে নেই) দৈনিক সংবাদ এর উপ সম্পাদকীয় কলামে প্রায় এ পৃষ্ঠাব্যাপী এক কলাম লিখে অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর মওলানা মতিউর রহমান নিজামীর (পাবনার বাসিন্দা) গ্রেফতার করে ফাঁসি দেওয়ার আবেদন জানাই। ঐ আবেদনে স্থানীয় কিছু কিছু সাক্ষীর বর্ণণাও উল্লেখ করি।

‘সংবাদ’ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নিবন্ধটি প্রকাশ করার মাত্র দু’দিন পর হঠাৎ করে ডাক যোগে এক নোটিশ পেলাম। নোটিশটি পাঠিয়েছিলেন মওলানা মতিউর রহমান নিজামী নিযুক্ত আইনজীবী বলে দাবী করে একটি ল’ইয়ার। তাতে লেখাছিল-আমি ঐ নিবন্ধটি সংবাদ এ প্রকাশ করে দেশের একজন বিশিষ্টজন নেতা ও আলেমের মানহানি ঘটিয়েছি। জামায়াতপন্থী ঐ আইনজীবী আজও পাবনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্র্যাটিস করেন এবং নানাভাবে পাবনা শহরে স্বল্পকালের মধ্যেই বেশ কয়েকটি বহুতল বাড়ীও সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিষয়টি দুর্নীতি দমন বিভাগ তদন্ত করে দেখতে পারেন।

যা হোক ঐ নোটিশ তিনি লেখেন, আমাকে নোটিশপ্রাপ্তির এক সপ্তাহের মধ্যে সম-আকারের আর একটি নিবন্ধ লিখে প্রকাশিত নিবন্ধ এবং তাতে উল্লেখিত সাক্ষী প্রমাণ মিথ্যা বলে লিখে সংবাদের একই পৃষ্ঠায় প্রকাশ করে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। এ নোটিশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখলাম। আমি যখন ওকালতি করতাম তার বেশ পরে কম বয়সী এক তরুণ (ঐ আইনজীবী) পাবনা বারে জয়েন করেন। সম্পদ গড়তে তাঁর সময় লেগেছে মাত্র তিন থেকে পাঁচ বছর। ইতোমধ্যে আরও কত বাড়ী, জমি ও সম্পদ কিনেছেন কত টাকা ব্যাংকে জমিয়েছেন তা কল্পনা করাও যাবে না।
যা হোক অত:পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালত অবশেষে গঠিত হলো-মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ বেশ কয়েকজন নেতৃ স্থানীয় কুখ্যাত জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আনা সরকারি অভিযোগ প্রমাণিত হলো এবং নিজামীসহ বেশ কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া এবং তা কার্য্যকর করা হলো। এখন কতগুলি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতার ফাঁসির আদেশ উচ্চতম আদালতে বিচারাধীন আছে।

আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ এই আপিল গুলির শুনানী, রায় ও তা কার্য্যকর করা হবে বলে মনে করা হয় তবে তা সন্দেহাতীত নয়। সন্দেহাতীত নয় কথাটি আসলে বেসুরো। আমাদের সকলেরই মনে আছে কয়েক বছর আগের শাহবাগ অভিযানের কথা। ঢাকার তরুণ সমাজ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিলম্বের প্রতিবাদে। উল্লেখ্য, তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে কিন্তু নানা কারণে বিচারের রায় প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীরা যাঁরা দিবারাত্র শাহবাগ ময়দানে লক্ষাধিক সংখ্যায় জমায়েত হয়েছিলেন-তাঁরা শুধুই ঢাকার তরুণ সমাজ নন-সারা দেশ থেকে এসে তাঁরা জমায়েত হয়েছিলেন। সম্মিলিত কণ্ঠে যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত ফাঁসির আদেশ এবং তা কার্য্যকর দাবী সহস্র কণ্ঠে-লাখো কণ্ঠে তুলেছিলেন।

এখানেই এ আন্দোলনের শেষ নয়। যতদিন পর্য্যন্ত তাঁদের ঐ বিপ্লবী দাবী মেনে নেওয়া ও কার্য্যকর করানা হয়-ততদিন দিবারাত্র নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অবস্থান করেছেন। সামান্যতম দুর্ঘটনাও ঘটেনি এমন অভিনব নারী-পুরুষের সম্মিলিত দিবারাত্র একত্রে অবস্থান করে আন্দোলন পরিচালনা করায়। এটি কোন রাজনৈতিক দল আয়োজিত কর্মসূচী ছিল না। তবে ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা ঐ সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সংহতি জানিয়েছিলেন নির্দলীয় এই যৌক্তিক সমাবেশকে।

অপরদিকে হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল নয় বলে তাদের নেতারা অহোরাত্র প্রচার করলেও, তারা শাহবাগের তরুণ সমাজের ঐ অরাজনৈতিক সমাবেশকে অতর্কিতে হামলা করতে দ্বিধা করেনি। তাতেও ঐ তরুণ-তরুণীরা ভয় পেয়ে থেমে যায়নি-বরং সকলে মিলে হেফাজতি সন্ত্রাসীদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে শাহবাগ এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।

অতঃপর সংশ্লিষ্ট উপরি মহল তাদের ছাত্র সংগঠন যারা স্বেচ্ছায় ওই সমাবেশে শরীক থেকে আন্দোলনটিকে বেগবান করে তুলতে সহায়তা করেছিল তারা তাদেরকে নীরবে ঐ আন্দোলন থেকে প্রতাহার করে নেয়। এরপরেও বাদ বাকী যারা ছিলেন তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে অপেক্ষাকৃত কম শক্তি নিয়েই।

অতঃপর একজন বিচাররত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির আদেশের রায় প্রকাশিত হলে তখন তারা সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়। বিজয় সূচিত হয় যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনের। তবে এখনও বেশ কিছু সংখ্যক ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর আপিলের শুনানী অনুষ্ঠিত বহু দিনযাবত না হওয়ায় অনেকের মনে নানা আশংকা বিরাজ করছে।

এই হলে জামায়াত-হেফাজতের অরাজনৈতিক (!) ভূমিকা-যা বাংলাদেশের মানুষকে আজও জীবন সংকায় ভোগাচ্ছে।
হেফাজত ইদানীং সর্বাধিক এগিয়েছে। সরকারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে পাঠ্য পুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ সহ অসাম্প্রদায়িক লেখক-কবিদের লেখা তুলে নিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখকদের লেখাকে পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করে শিশু শিক্ষার্থীদরকে সাম্প্রদায়িক হয়ে গড়ে ওঠার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়েছে। এতে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে দেশটি ঘোর সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হওয়ার আশংকার সৃষ্টি হয়েছে। এরপরে তারা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গনে নির্মিত একটি স্থাপত্য যা জাষ্টিসিয়া নামে পরিচিত সেটিকে ভেঙ্গে ফেলার দাবী তুললে সঙ্গে সঙ্গে তা অপসারণ করে সর্বোচ্চ আদালতটির পিছনের আঙিনায় অপসারণ করা হয়।

হেফাজতীদের দাবী অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের ডিগ্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীর সমতুল্য বলে স্বীকৃতি দিয়ে উচ্চ শিক্ষাকেও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারিভাবে গৃহীত বঙ্গবন্ধুর মূর্তি সর্বোচ্চ আকারে গড়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা করলে হেফাজত ঐ মূর্তি ভেঙ্গে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করলে সরকার চুপিসাড়ে কাউকে না জানিয়ে ঐ পরিকল্পনা বাতিল করেন।

এহেন দুই অপশক্তি জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের আরও বহু ভয়ংকর ক্রিয়াকলাপের সাথে পরিচিত ।এরপরেও তাদেরকে বৈধ সংগঠন হিসেবে সক্রিয়ভাবে চালু থাকতে দেওয়া হচ্ছে। এদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা কি তবে এতই কঠিন? কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো মাত্র নয় মাসে করেছিলেন। তাঁর সৈনিক বলে দাবীদাররাতা চৌদ্ধ বছরেও পারেন না কেন?

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।