রণেশ মৈত্র


বিপ্লবে দীক্ষা নিয়েছি ১৯৫০ সালে যখন পাবনাতে আমরা সমমনা কয়েকজন তরুণ একত্রিত হয়ে ‘শিখাসংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। শিক্ষক কতিপয় মার্কসবাদী বই। তখন পাকিস্তান আমলের প্রারম্ভিক কাল। কঠিন ধলনের সাম্প্রদায়িকতা, মানুষে মানুষে বিভেদ, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। ঐ জনাকয়েকের সবাই ভাবতাম, এই বিষময় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের পথ কি?

প্রশ্নটির জবাব পেলাম রবীন্দ্রনাথে, নজরুলে, সুকান্তে-তাঁদের বিপ্লবী কবিতায় গানে। কিন্তু সমাজতন্ত্র শব্দটার সাথে তখনও পরিচিত হতে পারি নি কারণ তাঁদের যে লেখাগুলি প্রড়েছি তাতে স্পষ্ট করে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি পাই নি। তবে ভাল লাগতো মার্কসীয় লেখকদের লেকা উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি তখনশব্দটির সাথে পরিচয় ঘটে। মার্কসীয় বইগুলি তখন আমরা কোলকাতা থেকে সবাই বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে চার আনা-আট আনা হলেই পোষ্ট্যাল অর্ডার পাঠিয়ে দিতাম ন্যাশনাল বুক এজেন্সীতে-তৎকালীন বাংলার সর্ববৃহৎ মার্কসীয় বই এর দোকান (ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির মালিকানাধীন) পোষ্ট্যাল অর্ডারগুলি ও বই এর তালিকা পাঠালে তাঁরা প্রার্থিত বইগুলি পাঠাতেন। এভাবেই এক পর্য্যায়ে হাতে এলো “ছোটদের রাজনীতি” “ছোটদের অর্থনীতি”। এই বই দুটি মার্কসবাদ-সমাজতন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের যে প্রাথমিক ধারণা দেয়-সমাজতন্ত্র বুঝতে প্রাথমিক পর্য্যায়ে আজও যথেষ্ট। কিন্তু বই দুটি এখন আর পাওয়া যায় কিনা জানি না।

বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে তাঁর প্রধান লক্ষ্য বলে তাঁর একাধিক ভাষণে ও লেখায় উল্লেখ করেছেন। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরর ক্ষমতায় থাকাকালেও। কিন্তু প্রতিষ্ঠা করার সময় পান নি। তবে সমস্ত মিল-কারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন, সেগুলি সরকারি মালিকানাধীন কারখানায় পরিণত হয়েছিল কিন্তু জনগণের মালিকানাধীন হতে পারে নি।

ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে তিনি ৩০ বিঘা মালিকানা নির্ধারণ করলেও তা টেকাতে পারেন নি। তাঁর দলের অভ্যস্তরস্থ জোতদার জমিদারদের চাপে শেষ পর্য্যন্ত জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। শিল্প-কারখানায় নিয়োগের ক্ষেত্রে মাত্র তিন কোটি টাকা ধার্য্য করে ক্ষুদ্র শিল্পে ব্যক্তি মালিকানা মেনে নিলেও বৃহৎ মালিকরা জাতীয়করণের বিরুদ্ধে দলের অভ্যন্তর থেকেই বিপরীত চাপ প্রদান করেন। শুধুমাত্র খোন্দকার মোশতাক নন, শুধুমাত্র জিয়াও নন-তাঁরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার পেছনে দলের ভিতরকার ধণিক বণিজেরাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন বাংলার এক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরবর্তীতে তাঁরাই হয়ে ওঠেন বেনিফিশিয়ারী। তারা ঐ হত্রালীলার প্রতিবাদে একটুকুও এগিয়ে আসে নি।

অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি সমাজতন্ত্রের শিক্ষায় শিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী কদাপি গড়ে না তোলায় দলে অসৎ লোকের সংখ্যা কিবপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে সক্রিয় থাকেন-জিয়ার মুশতাকের পিছনে সমবেত হন সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনার যে ভ্রুণ সৃষ্টি হয়েছিল-তার অংকুরেই বিনাশ করে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠায় জিয়ার মুশতাকের মন্ত্রী হওয়া। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের তৎক্ষণাৎ কোন প্রতিবাদ সংঘটিত হতে পারে নি। দীর্ঘকাল। তারা “বঙ্গবন্ধু” “জয়বাংলা” শব্দগুলিরও উচ্চারণ কার্য্যত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।

অত:পর জাতীয়করণকৃত কল-কারখানা ও কৃষিজমি ধনিকদের কাছে জলের দামে সরকার বিক্রী করে দেওয়ায় পুঁজিবাদ বাংলাদেশে মোটামুটি পূর্ণতা লাভ করে। আজ তা ফুলে ফলে বিকশিত হয়েছে। শহরে বন্দরে বহুতল সুরম্য প্রাসাদ একদিকে নির্মিত হচ্ছে, নির্মিত হচ্ছে নয়নাভিরাম বাজার-বিপণী-কিন্তু মানুষের কোটি কোটি সম্পত্তির অবৈধ মালিকানা অর্জন করা হচ্ছে শ্রমিক ও গরীব লোকদের বসতি অসংখ্য বস্তি আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করে পথে বসিয়ে দিতে। এটাই পুঁজিবাদ আগেই বলেছি পুঁজিবাদ মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে-গরীব মানুষের প্রতি শোষণ দিনে দিনে তীব্র করে তোলে।

পর পর দুটি সামরিক শাসন এলো বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। উভয় শাসকই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা আরও দৃঢ়তর করে তুললেন। আর সামরিক শাসন ও শাসকদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে-তাও তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে পুঁজিবাদ উচ্ছেদের লক্ষ্যে আদৌ নয়। ফলে সামরিক শাসকেরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থঅকে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করায়।

সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার পর বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এলো জামায়াতে ইসলামের সহযোগিতায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। পাঁ পাঁটি বছর ক্ষমতায় থাকালে এই সরকারও পুঁজিবাদকেই দৃঢ়তর করলেন ইসলামের নাম অপব্যবহার করে।

অত:পর ১৯৯৬ তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও তাঁর পূর্বসূরীদের পথেই থেকে গেলেন। এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধ কিন্তু পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্র নিয়ে নয়। ফলে পুঁজিবাদ আরও শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হলো। পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি এবার তারা জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতাকে সঙ্গী করে মন্ত্রীসভা গঠন করে পুঁজিবাদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ২০০৮ এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ এক দলীয় শাসন চালু করে।
বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র থাকলেও এই চার মৌলনীতির কোনটি উধাও-কোনটি আবার উধাও হওয়ার লক্ষ্যে বাস প্যাঁটরা গোছাতে ব্যস্ত।

প্রশ্নোত্তরে জানা যায়, জঙ্গীপনার উত্থান ঘটায় পুঁজিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা চালু রাখা দুরূহ। রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামের প্রবর্তক হোসায়েন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করলেন নিজ ক্ষমতার ভিন্ন স্থায়ী করতে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নয়। এই ঘটনা ঘটানো হয় ১৯৮৮ সালে। তখন উভয় নেত্রীর নেতৃত্বে বাম গণতান্ত্রিক শক্তি সহ-আন্দোলন হয় রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ্ সংবিদান থেকে বর্জন করতে। অত:পর ২০০৮ এর নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতাশীল হলো আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠত নিয়ে। প্রতিশ্রুত ক্ষত বিক্ষত সংবিধানটি আজও জামায়াতের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে, নতুন করে জঙ্গী উৎপাদনকারী উগ্র ধর্মীয় সহিংসতায় বিশ্বাসী হেফাজতে ইসলামের সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করায় আজ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ-সবই অতীতের বিষয়ে পরিণত হওয়াতে শক্ত ও মজবুত ভিত তৈরী হয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার।

মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রথমবারের মত বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের কাছে তা অধরাই রয়ে গেল। শ্রমজীবী মানুষের পিঠ আজ দেওয়ালে ঠেকেছে। বেকারত্বকে চিরসাথী হিসেবে পেয়ে তারা আজ অসহায়ত্বের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।

অপরদিকে গাড়ী, বাড়ী, বহুতল ভবন, দেশ-বিদেশে ব্যবসায় বাণিজ্য, দামী দামী বাড়ীঘর নির্মাণ ব্যাংক লুঠপাট করে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাঠানো ও আজ তাদের জন্র এক অলিখিত বৈধতা পেয়েছে।
ফলে সমাজদেহে ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে যে দুর্গন্ধময় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছেÑতার বিদায় ঘটাতে প্রয়োজন উচ্চতম

সার্জারীর। এই সার্জারী সফলভাবে করতে পারেন ধনীকরা তো নয়ই-আমাদের মত মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্তরাও যারা অহর্নিশি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখায় অভ্যস্ত।

তাই শ্রমজীবী সহায়-সম্বলহীন মানুষই একমাত্র হতে পারেন একমাত্র সফল এবং বিশেষজ্ঞ সার্জন-তবে ঐ সার্জারীর জন্য তাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে-সুদৃঢ় ঐক্যে নারী-পুরুষ মিলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেমন ঐক্য বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু গড়ে ছিলেন, মহামতি লেনিন গড়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে, হো চিমিন গড়েছিলেন ভিয়েতনামে, ফিদেল ক্যাষ্ট্রো গড়ে তুলেছিলেন আমেরিকার বুকে আমেরিকার বিরুদ্ধেই লড়াই করে কিউবান বিপ্লবীরা যেমন ঐক্য গড়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ায় সোয়েকানর্ডো, চীনে মাও সেতুং, মিশরে কর্ণেল নাসের, তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক প্রমুখ। এাঁরা সকলেই কমিউনিষ্ট ছিলেন তা না-অনেকেই ছিলেন জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল নেতা। রুশ বিপ্লবকে তাঁরা শিক্ষনীয় বলে বুরো নিয়েছিলেন, গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক রূপকে কেউ বহাল রেখেছিলেন-কেউ বা রাখেন নি। তবে তাঁরা সবাই, পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর মত গণতন্ত্রীকেও গভীর মিত্রে পরিণত করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কেও। শ্রদ্ধাশীল সবাই ছিলেন সকলেই। জোট নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক আন্দোলন, বিশ্ব নিয়ন্ত্রীকরণ আন্দোলন, বিম্ব শান্তি আন্দোলন এবং সর্বোপর গণতন্ত্র, ধর্মরিপেক্ষতা ও মানবাধিকারের বিশ্বশক্তি মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদসহ সকল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।

(চলবে....)

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।