ফরিদপুর প্রতিনিধি : সোনালী আঁশ পাটের রাজধানী খ্যাত ফরিদপুরের পাট চাষীদের মাঝে চরম দুর্দিন নেমে এসেছে। পাটের কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে তারা ক্রমেই পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। গতবারের তুলনায় জেলায় পাটের আবাদ কমে গেছে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর। পাটের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, পোকামাকড়ের আক্রম রোধে কৃষি বিভাগের সহায়তা না পাওয়া, পাট জাগ দিতে জলাশয়ের অভাব, ভালো মানের বীজ ও সার সঙ্কট পাটের আবাদ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।

দেশের সর্বাধিক গুণগত মান সম্পন্ন পাট উৎপাদিত হয় এই ফরিদপুর অঞ্চলে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় চলতি মৌসুমে ৭৫ হাজার ২শ’ ৬৩ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বিপরীতে আবাদ হয়েছে ৬৪ হাজার ৬শ’ ১৫ হেক্টর জমিতে। এরআগে ২০১৩-১৪ মৌসুমে এ জেলায় পাট চাষের লক্ষমাত্রা ছিল ৭০ হাজার হেক্টর। বিপরীতে আবাদ হয়েছিল ৭৫ হাজার হেক্টরে। ২০১২-১৩ মৌসুমে পাটের ভালো মূল্য পাওয়ায় কৃষকেরা ব্যাপকহারে পাট আবাদে ঝুঁকে পারেছিল। কিন্তু কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে তারা ক্রমেই হতাশ হচ্ছে।

জানা গেছে, বর্তমানে জেলার বিভিন্ন প্রসিদ্ধ হাটে পাট বিক্রি করতে এসে কৃষকেরা অনেকটা বাধ্য হয়েই লোকসান দিয়ে পাট বিক্রি করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে পাটের আবাদ আরো কমে যাবে বলে কৃষকদের আশঙ্কা। তবে সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতর দাবি করছে, বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল জাতের পাটবীজ ব্যবহারের মাধ্যমে পাটের আবাদ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ সাতৈর, কানাইপুর, তালমা, পুখুরিয়া, হাটকৃষ্ণপুরসহ পাটের বড় হাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের এক মণ সোনালী আশ বিক্রি হচ্ছে ১৪ শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫শ’ টাকা দরে। আর সাধারণ মানের পাট বিক্রি হচ্ছে ৮ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা দরে। পাটকলগুলোর হয়ে ফড়িয়া মহাজনদের সিন্ডিকেট দখল করেছে এসব বাজার। কৃষকেরা বাধ্য হয়ে কমমূল্যে পাট বিক্রি করছে ফড়িয়াদের নিকট। সংঘবদ্ধ এই ফড়িয়াচক্র আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের দাম কমে যাওয়ার অজুহাতে পাটের দরপতন ঘটাচ্ছে।

কৃষকেরা জানান, বাজারে ঘুরে কৃষকদের পাট বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে পাট নিয়ে বাজারে গেলে ব্যবসায়ীরা টানা হেচঁড়া শুরু করে দিতেন। সেখানে এখন পাট নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থেকে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে পাট বিক্রি করছেন। সিন্ডিকেটের কারণে পাটের বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রনে চলে যাওয়ায় বর্তমানে ১ মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ৮শ’ থেকে সর্বোচ্চ ১৫শ’ টাকা দরে।

পাটচাষীরা জানান, চলতি বছর যে হারে পাটের দাম পাওয়া যাচ্ছে তাতে লাভতো দুরের কথা পাট চাষের খরচই উঠবে না। বীজ রোপন থেকে বাজারে আনা পর্যন্ত সব মিলিয়ে পাট চাষ করতে কৃষককে উচ্চ হারে নগদ টাকা গুনতে হয়। অনেকে টাকা ঋণ নিয়ে বরগা জমিতে পাট চাষ করেছে। এখন দ্রুত পাট বিক্রি করে তাদের ঋণ শোধ করতে হবে। নাহলে প্রতিদিনই বাড়বে সুদের কিস্তি। ১ একর জমিতে পাওয়া যাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ মন পাট। এতে সবমিলিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়ছ। অথচ বাজারে বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার মতো। এর ফলে পাট বিক্রি করে খরচের টাকাই উঠছেনা। এর পর আছে ব্যাংক লোন, দাদন ও বরগা নেয়ার ব্যয়। সব মিলিয়ে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শঙকর ভৌমিক পাটের দাম কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এ অঞ্চলে মনপ্রতি পাটের মূল্য ২ শ টাকা করে কমেছে। ফরিদপুরে হেক্টর প্রতি ৮-৯ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। প্রতি মন পাট সাড়ে ১২ শ’ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। জুলাই মাসে নতুন পাট উঠার পর ১৪ শ’ থেকে ১৭ টাকায় পাট বিক্রি হয়েছিল।

এদিকে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর শনিবার ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচিত পাটচাষীদের সমাবেশে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রীর উপস্থিতিতি পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. রাখাল চন্দ্র বর্মন অবশ্য জানান, দেশে পাটের আবাদ বৃদ্ধির লক্ষে ফরিদপুরসহ দেশের ৪৪টি জেলায় উচ্চ ফলনশীল পাটবীজ সরবরাহের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে সাড়ে ১৬ লাখ একর জমিতে ৮৪ লাখ বেল পাট উৎপাদন করা হবে। এ প্রকল্পের অওতায় পাটচাষীদের মাঝে বিনামূল্যে পাটবীজ বিতরণসহ নানা সার এবং অর্থনৈতিক সহায়তাও দেয়া হবে। এর ফলে দেশে পাটের আবাদ বাড়বে বলে। একই সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কৃষকদের পাট সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক। ফলে কৃষক পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পাট চাষ বৃদ্ধির জন্য পাট ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচিত উৎপাদন খরচ কমানো ও মূল্য স্থিতিশীল রাখা সহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

যে কারণে কমছে পাটের আবাদ : ফরিদপুরের পাটচাষীরা জানান, অনেক জমিন পতিত থাকলেও লোকসানের শংকায় তা আর এ বছর আবাদের আওতায় আনেননি। মেশিন দিয়ে পানি দিয়েও খরার কারণে কোন লাভ হচ্ছে না। আবার মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে পাট আবাদ করেও পরে অতিবৃষ্টিতে চারাগাছ মরে গেছে। এরপর ছিল ছানা পোকা ও লেদা পোকার আক্রমন। এসব চাষীদের অভিযোগ, তাদের দুর্দিনে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদেরও পাশে পাননি। ফলে ক্ষেতের পাট বিনষ্ট হয়েছে পোকার আক্রমনে। এছাড়া পাট জাগ দিতেও কৃষকদের নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কৃষি বিভাগ উদ্ভাবিত রিবন রেটিং পদ্ধতিতে কৃষকেরা পাট জাগ দিতে উৎসাহী নন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এতে পাটের রং আসেনা। রিবন রেটিং পদ্ধতিতে জাগ দেয়া পাটের দামও পাওয়া যায় না। এছাড়া পাটখড়িও নষ্ট হয়ে যায়।

(আরআইআর/এএস/সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪)