আবীর আহাদ


অনেকদিন আগের কথা। ২০১০/১১ সাল হবে। অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক তখন সবেমাত্র নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। রাষ্ট্রদূতের অফিসে যোগদানের কিছুদিন পরে একদিন আমাকে ফোন করে কাঠমান্ডু যেতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি নিমবাবুর নিমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করি। এর ২/৩ দিন পর বাংলাদেশে ব্যবসা করেন ছোটভাইতুল্য এমন এক নেপালি সগীর খানের সাথে গুলশানের ওয়েস্টিন নামক পাঁচতারা হোটেলে দেখা। অধ্যাপক নিমের নিমন্ত্রণের কথা পাড়তেই সেও আমাকে চেপে ধরলো। সে বহুবার কাঠমান্ডুতে আমাকে নেয়ার কথা বলেছে, কিন্তু যাওয়া হয়নি। এবার আমাকে প্রবলভাবে ধরে ফেললো। অপরদিকে আমি তো কাঠমান্ডু যেতে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই রয়েছি।

মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছি। কখনো রাষ্ট্রদূত ড. নিমচন্দ্রের সরকারি বাসভবনে, কখনো নেপালি সগীরের বাসভবনে। প্রতিদিনই আমরা সন্ধ্যার পর আজ হয়তো অন্নপূর্ণা, কাল হিলটাউন, পরশু রেডিসান এমনি করে বিভিন্ন পাঁচতারার আড্ডায় সময় কাটাই। এ সময়ের মধ্যে রেডিসানে এক বাংলাদেশী উঠতি রাজনীতিক-কাম ব্যবসায়ীর সাথে দেখা। তিনি আমার পরিচিত। তবে তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। তার বাবা ছিলেন একাত্তরের পিস কমিটির একটা জেলার প্রথমসারির সংগঠক। আপাদমস্তক পাকিস্তানি। তার গুণধর পুত্র উঠতি রাজনীতিক-কাম ব্যবসায়ী বিএনপি রাজনীতির বলা চলে অন্ধ সমর্থক। তিনি নেপালের চেম্বারের সাথে একটা ব্যবসায়িক যোগাযোগের প্রয়োজনে কাঠমান্ডুতে এসেছেন। তিনি অধ্যাপক নিমচন্দ্রের সাথেও মোটামুটি পরিচিত।

আড্ডার এক পর্যায়ে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলো। রাজনীতিক-কাম ব্যবসায়ী আগে থেকেই ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই কীসব এলোমেলো আবলতাবল কথাবার্তা শুরু করলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেশের এক নাম্বার রাজাকার এবং তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের এক নাম্বার দালালসহ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতীয় চর বলে গালমন্দ করতে থাকলেন। এ অবস্থার কারণে আমার মেজাজ চরমে উঠলো। ঠাস ঠাস করে দু'টো চড় কষে দিলাম তার গালে। হোটেলের লোকজনের হস্তক্ষেপে আমাদের ঝগড়া থেমে গেল। চড় খেয়ে তার জবান বন্ধ যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কীসব বিড়বিড় করতে করতে উধাও হয়ে গেলেন।

এ ঘটনার ক'বছর পরে। ২০১৪ সালের নভেম্বর/ডিসেম্বর হবে। সেবারও সগীরের আমন্ত্রণে আমি কাঠমান্ডুতে। ফেরার পথে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকায় ফিরছি। কী সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার! সেই রাজনীতিক-কাম ব্যবসায়ীর পাশের সিটে আমার সিট হলো। আমি কিছুটা ইতস্ততঃ করতেই তিনি দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মুক্তিভাই, পৃথিবীটা আসলেই গোল। দেখেন তো আমাদের মধ্যে আবার সংযোগ হলো, এক মোহনায় এসেও মিললাম!

আমি বসতে বসতে তাকে বললাম, এক মোহনায় মিললাম, এর অর্থ কী মি?

রাজনীতিক-কাম ব্যবসায়ী হে:হে:হে করে হেসে উঠে বললেন, আমি এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির সহ-সম্পাদক! তিনি ননস্টপ বলে গেলেন, ভেবে দেখলাম, বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহান নেতা, জাতির জনক। জননেত্রী মাননীয়া শেখ হাসিনা সত্যিকারার্থে একজন দেশপ্রেমিক।

আমি বললাম, আর মুক্তিযোদ্ধারা কি এখনো ভারতীয় চর হয়েই রয়েছে?

নব্য আওয়ামী লীগ নেতা-কাম বড়ো মাপের ব্যবসায়ী ভদ্রলোক আমার মাথায় মৃদু টোকা দিয়ে হাসি হাসি কণ্ঠে বললেন, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জন্য এই দেশ এই স্বাধীনতা।

আমিও প্রত্যুত্তরে বললাম, তাহলে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের আপনি আগে যেসব বিশেষণে(!) ভূষিত করেছিলেন, সেসব গেলো কোথায়।

মুক্তিভাই, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই আমার দিকে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে তিনি বলতে লাগলেন, বিশেষ করে বাংলাদেশে ভালোভাবে জীবনযাপন করত হলে আপনাকে 'যেখানে যেমন সেখানে সেমন' নীতি নিয়ে চলতে হবে। নীতি-নৈতিকতা, চেতনা, আদর্শ ও দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই। আর রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই, স্যার! দেবতাকে তুষ্ট করে চলেন, আপনি তরতরিয়ে উপরে উঠে যাবেন এ ধরনের রীতিমতো একটা ভাষণ দিয়ে ফেললেন সেই নব্য আওয়ামী লীগার।

রাজাকার-পুত্র বিএনপির সাবেক পুচকে রাজনীতিক-কাম ব্যবসায়ী এখন কোনো এক দরবেশের আশীর্বাদে আওয়ামী রাজনীতি ও ব্যবসার উচ্চ শিখরে অবস্থান করছেন বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।