রণেশ মৈত্র


১৭ মার্চ চলে গেলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের শততম জন্মদিন। আর জন্ম শতবার্ষিকী চলবে ২০২১ এর ১৬ মার্চ পর্য্যন্ত। করোনা ভাইরাসের আকস্মিক প্রাদুর্ভাব জনিত কারণে এই শত বার্ষিকীর তাবৎ আনন্দানুষ্ঠান স্থগিত করতে হয়েছে-পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে এই শতবার্ষিকী যথাযথ উদ্দীপনায় উদযাপিত হবে।

আজ যখন এই নিবন্ধটি লিখতে বসেছি তখন বঙ্গবন্ধুর, আমার মুজিবভাই এর শত তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন। এইদিন সকালে ভাবছিলাম বঙ্গবন্ধু যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে যতই কেন না করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত আতংকের সৃষ্টি হয়ে থাকুক বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত হাজারে হাজারে মানুষ যে ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়ীতে ফুল-মিষ্টি হাতে নিয়ে দিনভর গিয়ে পৌঁছাতেন এবং তার ফলে কী অপূর্ব দৃশ্যেরই না অবতারণা হতো। হয়তো বা করোনা ভাইরাসই বিপুল জন সমাগম ও আনন্দে উৎফুল্ল মানুষকে দেখে বাংলাদেশ ছেড়ে দূরে পালাতো। কিন্তু বাঙালির ভাগ্যে তেমনটি জুটলো না। দিনটি তাঁর দৈহিক অনুপস্থিতিতেই পালন করতে হলো সাধ্যমতো।

কিন্তু সাথে সাথে ভাবনায় এলো অতীতের কিছু বেদনাময় স্মৃতি। সেটা কি রক্তাক্ত ১৫ আগষ্ট? না, তা নয়। ১৫ আগষ্টের শোকাবহ দিনটির আগের কয়েকটি দিনের কথা বলছি।

সাল ১৯৭৫। তারিখ ৭ কিংবা ৮ আগষ্ট। হঠাৎ করে পাবনা থানার পাশে তখন অবস্থিত আমার সাবেক বাসার সামনে একটি গাড়ী এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে দেখি ঐ গাড়ী থেকে একজন নেমে এসে আমার বৈঠক খানায় ঢুকলেন। আমিও সেখানেই বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। আবাস্তক দাঁড়িয়ে আছেন দেখে বসতে বললাম। তিনি বসলেন না। বললেন মিনিষ্টার সাহেব আপনাকে সালাম দিছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম মিনিষ্টার মানে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব। আগ-ক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন আর বললেন, আমি আপনার জন্য গাড়ী নিয়ে এসেছি। বললাম, ঠিক আছে, ready হয়ে আসি।

যত দ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে এসে গাড়ীতে উঠে বসলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবের বাসায় পৌঁছে দেখি ক্যাপ্টেন সাহেব আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী পরিবেষ্ঠিত হয়ে তাদের সাথে কথাবর্তা বলছেন।

আমাকে দেখেই বলে উঠলেন রণেশ, এসে বসো। আর তাঁর দলীয় নেতা কর্মীদেরকে বললেন, তোমরা অন্য কোন রুমে যাও। রণেশদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। তাঁরা চলে গেলেন।

কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা সুরু করার আগেই কুশলাদি বিনিময়ের মাঝখানেই ন্যাপ নেতা প্রয়াত আমিনুল ইসলাম বাদশাকে এবং সিপিবি নেতা কমরেড প্রসাদ রায় এসে ঢুকলেন। একজন কর্মীকে দরজা জানালা বন্ধ করে ভিন্ন রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন।

এবারে শুধুমাত্র চারজন আমরা বসা। এটা মন্ত্রী মহোদয়ের বিশাল বৈঠকখানা। কথা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব নিজেই। প্রশ্ন আমারে বললেন, দেশের পরিস্থিতি কেমন মনে করছো তোমরা? বললাম, খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করছি জরুরী অবস্থা জারী করায়। এটা এই মুহুর্তে তুলে নেওয়া উচিত।

ক্যাপ্টেন সাহেব জানতে চাইলেন কেন জরুরী অবস্থা তুলে নিতে বলছি। বললাম, কুষ্টিয়ার এক নেতাকে জাসদ পন্থীরা গুলি করে হত্যা করার পরই জরুরী অবস্থা জারী করা হলো এবং একই সাথে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকা-কেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। ফলে যারা গোপন রাজনীতি করে যারা অস্ত্রের রাজনীতি করে যারা মানুষ মারা রাজনীতি করে তাদের কোনই অসুবিধে হয় নি। কারণ তারা তাদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র, যাবতীয় কর্মকাণ্ড গোপনেই চালায়-পুলিশও তা টের পায় না। কিন্তু আমরা যারা ঐ রাজনীতিতে বিশ^াসী নই বা দেশ গঠনের জন্য শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে চলেছি ১৯৭২ থেকে তারাই পড়লাম বিপাকে। এবং তা এতটাই যে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কোন নেতা কর্মীকে তারা হত্যা করলে তার প্রতিবাদে আমরা কোন মিছিল বা জনসমাবেশের আয়োজন করতে পারবো না।

ক্যাপ্টেন মনসুর একমত হলেন। যতদূর মনে পড়ে, তিনি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। বাকশালের গঠন প্রক্রিয়া চলমান অপরদিকে জাসদ, নকশাল এবং রাজাকারেরা অস্ত্রের রাজনীতি চালিয়ে শুধুমাত্র মানুষ খুনই করছে না তারা দেশে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা ভাজছে। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, দেখ জরুরী অবস্থা নিয়ে যা বলেছ তা ব্যক্তিগতভাবে আমি সমর্থন করি বটে কিন্তু মুজিবর (বঙ্গবন্ধুকে তিনি মুজিবর বলেই ডাকতেন)এটা জারী করিয়েছে তার কড়া মত হলো জরুরী অবস্থা জারী না করলে ওদের ষড়যন্ত্র রুখা যাবে না। এখন দরকার ঐ কাজে যারা লিপ্ত-ব্যাপকভাবে তাদেরকে ধর পাকড় করে তাদেরকে জেলে পুরা এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং অন্যান্য অভিযোগে মামলা দায়ের করা।

ক্যাপ্টেন মনসুর বলে চললেন, আসলে আমার মনে হয় গভীর এক ষড়যন্ত্র চলছে খোদ মুজিবরকে নিয়ে। এই আশংকার কথা মুজিবরকে কয়েকবার বলেছি। জবাবে সে বলে, “কোন বাঙালি আমার গায়ে হাত তুলবে না-তোমরা বরং নিজেদেরকে সামলাও”।

ক্যাপ্টেন মনসুর শাহজাদপুর এসেছিলেন ঐ বছরের রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবের প্রধান অতিথি হিসেবে। পরদিন সেখান থেকে তাঁর পাবনা আগমন।

বস্তুত:ই তখন দেশজুড়ে এক ধরণের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। চারটি বাদে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং চারটি পত্রিকাও সরকারি প্রসংসা ব্যতিরেকে তেমন একটা কিছু লিখতে পারছিল না। যেন এক দম বন্ধ করা অবস্থা।

আমরা বললাম, জরুরী অবস্থা জারী থাকায় ষড়যন্ত্রকারীদেরই তো সুবিধা হয়েছে। আমরা যারা শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করি, তারা তো জন-জমায়েত সংগঠিত করে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করার সুযোগ পাচ্ছি না। ফলে জনগণের মধ্যেও একটা নেতিবাচক মনোভাব ফুটে উঠছে। এর অবসান ঘটানো প্রয়োজন অতি দ্রুত। নইলে বঙ্গবন্ধু, ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে।

আরও বললাম, বাকশাল নিয়েও দেশে চরম বিভ্রান্তি রয়েছে জনগণের মধ্যে এবং বাকশাল বিরোধী প্রচার প্রচারনা দিব্যি হালে পানি পাচ্ছে। এগুলি সবই ভবিষ্যতে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন, শেখ ফজলুল হক মনি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে কয়দিন আগে ঢাকায় আমার বাসায় এসে বললেন, শীগরির খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রীসভা থেকে অপসারণ করে কারারুদ্ধ করা হোক। মোশতাকই হলেন সকল ষড়যন্ত্রের নায়ক। তাকে বললাম তুমি তো মুজিববের ভাগনে তোমার বলাতেই ফল ফলতে পারে। এ কথার জবাবে শেখ মনি বললো, আমি ভাগনে তাই কিছু বলতে গেলেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তুমি কি বুঝ? বাঙালী কি কোনদিন আমার গায়ে হাত তুলতে পারবে? আর মোশতাক? সে তো আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কাজে তার মাধ্যমে তাঁর বা দেশের কোন ক্ষতি হবে না।

এ বিষয়গুলি তৎকালীন পরিস্থিতিতে এত খোলামেলা আলোচনা হবে তা ভাবিনি। বিষয়গুলি আমাদের জানাও ছিল না ভালভাবে। কিন্তু বিস্তারিত শুনে একদিকে জাসদ রাজকার নকশাল সৃষ্ট বিপদ অপরাদিকে একাত্তরে আমেরিকার সাথে মোশতাকের স্বাধীনতা বিরোধী গোপন ষড়যন্ত্র, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলি কর্তৃক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতার ঘটনা এবং কাহিনীগুলি স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগলো। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম।
খোন্দকার মুশতাকের সাথেও দীর্ঘদিন পাবনা জেলে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছি ষাটের দশকে। ঐ দশকেই ঢাকা সেন্টাল জেলে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে (পাশাপাশি ওয়ার্ডে) থেকে আমার উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক সম্যক বেশ একটা ধারণা অনেক আগেই গড়ে উঠেছিল।

পাবনা জেলে দিনের বেলায় খোন্দকার মোশতাক এবং আমরা কয়েকজন প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে খাওয়ার পর তাস খেলতাম। ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক আলাপ-সালাপও হতো। একদিন তিনি বলে বসলেন, মজিবর আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করে দিল। কমিউনিষ্ট ও মওলানা ভাসানীর সাথে সাথে হাত মিলিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগটাকে আওয়ামী লীগ বানালো মুসলিম শব্দ তুলে দিয়ে। এই কথার সাথে মনে পড়ছে একাত্তরে মুজিব নগরে খোন্দকার মোশতাকের কীর্তি কাহিনী। সেখানে তিনি পররাষ্ট মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে মার্কিন দূতাবাসের সাথে গোপন সংযোগ রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে একটা কনফেডারেশনের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন এবং সে কারণে তখন থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্য্যন্ত তাঁকে নজরবন্দী করে রেখে কার্য্যত: বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উপর অর্পিত হয়েছিল।

এক্ষণে বঙ্গবন্ধু ঐ ষাটের দশকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালে যে ডায়েরী লিখেছিলেন তা বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে “কারাগারের রোজনামচা” নামে। বইটির ১৫৭ পৃষ্ঠায় তিনি নিজেই লিখেছেন, “সন্ধ্যার তালা বন্ধ করার সময় বাইরের দরজাটা একটু খুলেছিল। তাই দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। আবার বললাম, পাবনা যাবেত বোধ হয়। বন্ধু মোশতাককে পাবনা জেলে নেওয়া হয়েছিল। বোধ হয় সেখানেই আছে, কেমন আছে জানি না। তাকে খবর দিতে বলবেন।”

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেখানে থাকতেন তেওয়ালী ওয়ার্ডে আমাকে রাখা হয়েছিল পুরাতন বিল সেলে। সামনা সামনি অবস্থান। তাই নিষেধাজ্ঞা সত্বেও দু’জন গোপনে সকাল-বিকেল একত্রে হাঁটতাম। সেই সময় আমার পথে যা কথাবার্তা হতো-বঙ্গবন্ধু তা তাঁর ডায়রীতে নোট রাখতেন। কারাগারের রোজনামচা ৮৫, ৯০, ১১৮, ১৫৭ ও ১৬১। এ স্মৃতিগুলি আজ মানসপটে ভেসে উঠছে।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।