মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে দেশীয় মুদ্রা সংস্করণে দশ টাকার নোটের প্রচ্ছেদে স্থান পাওয়া চারশ’ বছরের পুরনো মসজিদটির গ্রাম আটিয়া। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ী, পেড়াবাড়ীর চমচম, মধুপুরের আনারস, সাগরদিঘীর সাগর কলার সাথে আর একবার যুক্ত হলো এ গ্রামটি। টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার অর্ন্তগত আটিয়া ইউনিয়নের আটিয়া গ্রাম ইতোমধ্যে জেলায় পাঙ্গাসের গ্রাম নামেই দ্যুতি ছড়াচ্ছে। প্রায় ছয় হাজার মানুষের এ গ্রামে প্রায় সবাই অতোপ্রতভাবে জড়িয়ে পরছে পাঙ্গাস চাষের সাথে।

কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে উঠতে না পেরে ও পাঙ্গাস চাষ লাভজনক হওয়ায় সহজেই পেশা বদলের সিধান্ত গ্রহণ করেছেন এ এলাকার প্রান্তিক চাষীরা। এরই ধারাবহিকতায় পোনা মজুদ, পাঙ্গাস চাষ, মাছ ধরা, এমনকি বাজারে বিক্রি করাকে কেন্দ্র করে গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাঙ্গাস চাষ করছে। বিগত দুইযুগ ধরে পাঙ্গাস চাষে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। বাড়ি-বাড়ি পুকুর আর পুকুর ভরা পাঙ্গাস। নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশের নদী জলাশয়ে প্রথম পাঙ্গাস চাষ শুরু হলেও পরবর্তীতে পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেলে পুকুরে পাঙ্গাস চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এসময় পুকুর বা ডোবায় দেশী ও থাই পাঙ্গাস চাষে ঝুঁকেছে মাছ চাষীরা।

এক সময় পাঙ্গাস উচ্চবিত্তের মাছ হলেও পুকুর বা ডোবায় চাষ হওয়ার কারনে তা বেশ সহজলভ্য হয়ে পরে। শুধু তাই নয়, পাঙ্গাসের গায়ে কোন আঁশ নেই, খেতেও সুস্বাদু ও প্রতিকূল পরিবেশে সহজেই বেঁচে থাকতে পারাও পাঙ্গাস চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠার অন্যতম কারণ। দেলদুয়ার তথা আটিয়া অঞ্চলের পুকুরের মাটি ও পানির গুনগত মান এবং পুষ্টিকর খাবারে উৎপাদিত পাঙ্গাস জেলার মানুষের আস্থা কুঁড়িয়েছে। জেলার নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের আমিষের চাহিদা পুরণ করছে আটিয়ার পাঙ্গাস। ১৯৯৪ সালে আসাদুজ্জামান আসাদ নামের এক ব্যক্তি প্রথম আটিয়াতে পাঙ্গাস মাছ চাষ শুরু করেন। আসাদের মত এরকম সফল চাষীর সংখ্যায় নেহাত কম নয়। তার সফলতায় উৎসাহিত হয়ে আটিয়ার ঘরে-ঘরে তৈরি হয়েছে পাঙ্গাস চাষী। এই গ্রামে প্রায় দেড় শতাধিক পুকুরে এখন পাঙ্গাস চাষ হচ্ছে।

পাঙ্গাস চাষী আসাদ জানালেন, এখন তার চারটি পুকুর। দুইটিতে ৩০ হাজার পাঙ্গাস চাষ করেন। বাকি দুইটি পুকুরে পাঙ্গাসের পোনা মজুদ রাখেন। আমি প্রথম এই গ্রামে পাঙ্গাস চাষ শুরু করি। গ্রামে এখন দেড় শতাধিক পুকুরে পাঙ্গাস চাষ হচ্ছে। বর্তমানে খাবারের দাম দ্বিগুন। ৭/৮ শ’ টাকা মূল্যের খাবারের বস্তা হয়েছে ১৭/১৮শ টাকা। মাছের দাম আগের মতোই রয়েছে। পাঙ্গাস চাষে দুইবার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেরা চাষীর পুরস্কার পেলেও বর্তমানে পাঙ্গাস চাষ নিয়ে হতাশায় রয়েছেন আসাদ। পাঙ্গাস চাষ ঘিরে গড়ে উঠেছে মাছের খাবার তৈরীর ছোট ছোট শিল্প। যাদের একাধিক পুকুর রয়েছে তারা খাবারের দাম বৃদ্ধিতে বেছে নিয়েছেন বিকল্প পথ। খাবারে দাম বেড়ে যাওয়ায় হোঁচট থেকে বাঁচতে খাবারের সব ধরনের কাঁচামাল কিনে কারখানা থেকে ভাঙিয়ে বাড়িতে খাবার তৈরি করা হচ্ছে।

কথা হয় তেমনি এক পাঙ্গাস চাষী ডা. লুতফর রহমান ও জায়েদুর রহমানের সাথে। তিনি জানালেন, সাত ভাই মিলে ৬টি পুকুরে পাঙ্গাস চাষ করেন। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডা. লুতফর রহমান নিয়েছেন বিকল্প পদ্ধতি। খাবারের সব ধরনের কাঁচামাল কিনে কারখানা থেকে ভাঙিয়ে নেন। ফলে মাছের খাবারের উর্ধ্বগতিতেও লাভের হিসেব আগের মতোই গুনছেন তিনি। কয়েকজন আবার বাড়িতে খাবার তৈরির জন্য ছোট আকারের মেশিন নিজেই ক্রয় করেছেন। তাদের খাবার খরচ আরও কমে এসেছে। তবে বেকায়দায় পড়েছে যেসব চাষীরা প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ায়। এতোকিছুর পরেও পাঙ্গাস চাষে জীবন পাল্টেছেন অনেকেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা নারী ঝরনা শুরু করেন পাঙ্গাস চাষ। বেঁচে থাকা অবস্থায় স্বামীর কাছ খেকে শিখেছিলেন কিভাবে পাঙ্গাস চাষ করতে হয়। মাছ চাষ করেই দুই মেয়ের বিয়ের খরচ যুগিয়েছেন তিনি। বাকি দুজনের ভরণ পোষণের জন্য মাছ চাষ ছাড়েননি এখনও। ঝরনার মতো গ্রামের অনেকেই পাঙ্গাস চাষে ঝুঁকছেন। ফলে এ গ্রামে বেকারত্ব নেই বলেই চলে। সবাই এখন স্বাবলম্বী। প্রতি হাজার পাঙ্গাস চাষ করে বছরে ২৫/৩০ হাজার টাকা উপার্জন করেছে চাষীরা। একজন চাষী ২৫ থেকে ৩৫ হাজার পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অর্থনৈতিক চাকা বদলে দিয়েছে।

একদিকে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছে, অন্যদিকে গ্রামের অর্থনীতিকে মজবুত করেছেন। মাছের বর্তমান পাইকারী বিক্রয় মূল্য মন প্রতি ৪ হাজার খেকে ৪হাজার ২শ’ টাকা। পাঙ্গাস চাষে খাবারের দাম দফায়-দফায় বেড়ে দ্বিগুন হলেও মাছের পাইকারী দাম কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১০৫ টাকার মধ্যেই থাকছে। সম্প্রতি চাষীরা ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হচ্ছে। তবে গত কয়েক বছরে ধাপে-ধাপে বেড়ে খাবারের দাম দ্বিগুন হওয়ায় পাঙ্গাস চাষের আগাম দিনগুলো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। খাবারের দাম না কমলে পাঙ্গাস চাষ থেকে ছিটকে পড়বে চাষীরা এমনটাই ভাবছেন এ পেশার সাথে সম্পৃক্তরা। প্রয়োজন খাবারের দাম কমানো। প্রয়োজন সরকারি সহেযোগিতা।

দেলদুয়ার উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান জানান, আটিয়ার পাঙ্গাস প্রসিদ্ধ। পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমরা সাধ্যমতো পাঙ্গাস চাষীদের সহযোগিতা করছি। প্রশিক্ষণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে মৎস্য অফিস সবসময় এসব মাছ চাষীদের পাশে আছে।। পোনা মজুদ, পাঙ্গাস চাষ, মাছ ধরা, এমনকি বাজারে বিক্রি করাকে কেন্দ্র করে গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাঙ্গাস চাষের সাথে যুক্ত। দুইযুগের পাঙ্গাস চাষে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।

আটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. সিরাজুল ইসলাম মল্লিক জানান, আটিয়া একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এ গ্রামের মানুষ মূলত কৃষি কাজের উপরই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে পাঙ্গাস চাষে সাফল্য পাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই পাঙ্গাস চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। তিনি আরও জানান, জেলার অন্যান্য এলাকায় চাষ করা পাঙ্গাসের তুলনায় আটিয়ার পাঙ্গাস স্বাদের ভিন্নতায় অতুলনীয়। তাই এ এলাকার পাঙ্গাসের চাহিদাও বেশি।

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল হক জানান, দেলদুয়ারের আটিয়ার পাঙ্গাস প্রসিদ্ধ। পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তারা সাধ্যমতো পাঙ্গাস চাষীদের সহযোগিতা করছেন। জেলা-উপজেলা মৎস্য অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে মাছ চাষীদের পাশে রয়েছেন।

(এসএম/এসপি/ডিসেম্বর ০৭, ২০২১)