কামাল শাহরিয়ার : ‘বীরাঙ্গনা মাতা’ নামটি আমাদের স্বাধীনতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এদের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতার  ইতিহাসে একটি অংশ। এইসব বীর রমণীর অনেক সাহসিকতার জন্য অনেক কাজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যুগিয়েছে এবং এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর।

তবে দুঃখজনক বিষয় হলো আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত এই বীর মাতাদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অনেক সভা-সেমিনারে রীবাঙ্গনা মাতাদের সংখ্যা দুই লাখ বলা হলেও বিভিন্ন অনুসন্ধানে এটি চার লাখেরও বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৪১ বছরেও বীর মাতাদের কোন হিসেবে না থাকাটা লজ্জার বলে মনে হয় আমাদের।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি সমাজের এক শ্রেণীর লোক এদের মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত হয়। এইসব লোকদের কুলাঙ্গার ছাড়া অন্য কিছু বলা ঠিক নয়। বীর রমণীরা, যারা এদেশের স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ অংশ তাদের সম্মান করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।

আমাদের দেশের সরকার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বা বেসরকারিভাবে কোন্ও সংগঠন তাদের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী বলে মনে হয় না। তারাও ঐসব অন্ধ মানুষের সারিতে অবস্থান করছে। এটা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে অসম্মান করারই নামান্তর।

আজ রোববার ২৬ ফেব্রুয়ারি ছিল মহান বীরাঙ্গনা দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে (২৬ ফেব্র“য়ারি, শনিবার) বাঙালি জাতির জনক মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, “আজ থেকে পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত।কেননা দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাঁদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাঁদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, “আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন।”

কিন্তু এ দিনটিতে আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোকে কোন বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা গেলা না এবার। এ থেকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদীরা হয়তো পুলকিত হতে পারে কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির আফসোস করা ছাড়া অন্য কোন্ও পথ খোলা নেই।

শুধু কোন বিশেষ কর্মসূচি কেন মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা আমাদের বীর মাতাদের খবর নেয়ার কোনও আগ্রহ নেই কারো। তারা হয়তো ভুলেই গেছে, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পশু-সৈন্যদের নারী ধর্ষণ ও হত্যালীলা মানব সভ্যতার সব যুগের সব নজিরকে ম্লান করে দিয়েছে। এই মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের সহযোগিতা করেছে এদেশেরই ঘাতক রাজাকার, আলবদর, আল-শামস্ বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নরপশুরা ৭ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাকেও ধর্ষণ করেছে। অসংখ্য বাঙালি নারীকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ছাত্রী থেকে শুরু করে দিনমজুরের স্ত্রী-কন্যারাও তাদের পাশবিক ক্ষুধার শিকার হয়েছে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের লোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। এই নরপশুদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতায় বিশ্ববিবেক ঘৃণায় আঁতকে উঠেছিল।

এ নিয়ে ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছিল: ‘লন্ডনস্থ বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের স্টিয়ারিং কমিটির আহবায়ক জনাব আজিজুল হক ভূঁইয়া ‘রেপ্ অ্যাট রোকেয়া হল’ নামে একখানা স্মারকলিপি বের করেন। স্মারকলিপিটি নিয়ে পড়তে শুরু করেই একজন বৃটিশ মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘না, না। আমি আর পড়তে পারছি না। একি সত্যি যে, কেউ এ অত্যাচার বন্ধ করতে পারে না? হায় প্রভু! এ যে নাৎসিদের চেয়েও ঘৃণ্য!’

তাছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেসব নারী লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সতীত্ব বা সম্ভ্রম হারিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের বীরঙ্গনা ভিধায় ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতা অর্জনের কিছুদিন পর সম্ভ্রমহারা কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কী?’
জাতির জনকের এই ঘোষণার পর থেকে বীরাঙ্গনা শীর্ষক সম্মানসূচক উপাধি প্রবর্তনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনাটি সেদিন লোকলজ্জা ও মানসম্মানের ভয়ে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা গোপন রেখেছে। তারা তাদের অসহায় অবস্থার কথা রাষ্ট্রকে জানাতে আসেননি। যেসব নারী নিজ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সহানুভূতি পায়নি তাদের এক দল আত্মহত্যা করে সম্ভ্রমের সঙ্কট থেকে মুক্তি নিয়েছে, আরেক দল জনস্রোতে হারিয়ে গেছে, আর শেষ দলটির কেউ বাঁচার অদম্য স্পৃহা থেকে, কেউ প্রতিবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে, কেউবা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যকে বাঁচার অবলম্বন বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাপান ও ভারতীয় চিকিৎসকদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের স্থাপিত গর্ভপাত কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। এসব গর্ভপাত কেন্দ্রে কিছু কিছু পরিবারের পক্ষ থেকে অভিভাবকরা তাদের নির্যাতিত ও গর্ভবতী স্ত্রী বা কন্যাদের নিয়ে গেলেও অনেক নির্যাতিত মা-বোনই গর্ভপাত ঘটাতে অস্বীকার করেন। অথবা গর্ভপাতের সময় অতিক্রম করে অনাগত সন্তানটি প্রসবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ায় তারা সন্তান কামনা করেন। পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখার পর এই নবজাতক সন্তানদের নাম হয় যুদ্ধশিশু। নানা তথ্যের সমাহার থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের সংখ্যা আড়াই লাখের উপরে। এরা এখন কোথায়? আমরা কেউ জানি না! কিন্তু ইতিহাস জানে!!

কিন্তু বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে সামরিক শাসকরা এই সম্ভ্রমহারা নারীদের কোনো খোঁজ-খবর তো রাখেই নি, প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও দেয়নি। তার পরের নির্বাচিত সরকারগুলোও যেন বীর মাতাদের যথার্থ সম্মান দেখাতে কার্পণ্য বোধ করছে।হাতে গোনা দু’চারজন বীরাঙ্গনা যারা আছে তারা দীর্ঘ অবহেলায় ও উপেক্ষায় এখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন।

তাই তো মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতনের শিকার বীরাঙ্গনা রাহেলা খাতুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন ‘আমরা বীরাঙ্গনা হলাম কিভাবে? আমরা কি মুক্তিযুদ্ধ করি নাই? অথচ সরকার আমাদের জন্য কিছুই করতেছে না। আমরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চাই, ভাতা চাই।।’

এবিষয়ে এক অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা সহযোগিতা করলে বীরাঙ্গনা মায়েরাও লজ্জা নয় বরং জাতির শ্রেষ্ঠ মা হয়েই গৌরববোধ করবে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযোদ্ধারা শুধু তাদের কথাই বলে, বীরাঙ্গনা মায়েদের কথা তারা বলতেই চায় না।

তাই আমাদের প্রত্যাশা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা বীর মাতাদের শুধু বিরাঙ্গনা নয়, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও স্বীকৃতি দিতে হবে। এর পাশাপাশি তাদের ভাতা, নিরাপত্তাসহ সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। তাদের এবং তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে তাদের অবদানের পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে। আর তা না হলে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বীর মাতাদের অবদান আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে গুরুত্বহীন হয়েই থাকবে।

লেখক : সংবাদকর্মী