রণেশ মৈত্র


লেখার বিষয়ের অন্ত নেই। প্রতিদিন টেলিভিশনে দেশী-বিদেশী চ্যানেলগুলি দেখলে তা চোখে ধরা পড়ে। কিন্তু চ্যানেলগুলি তো শুধুই হেডলাইন প্রচার করে। তাই অপেক্ষা করতে হয় পরদিন সংবাদপত্র পাওয়ার জন্য। 

আজ যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি তা নিয়ে একটি পূরা সপ্তাহ জুড়ে কী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে কী সংবাদপত্রগুলিতে কী অনলাইন প্রচার মাধ্যগুলিতে কী চায়ের দোকানে অফিস-আদালতে আলোচনার ঝড় উল্কার বেগে ছুটছে। আর যাঁকে নিয়ে এই ঝড়টি উঠেছে তাঁর ছবি এই কয়দিনে সর্বাধিক প্রাধান্য পাওয়ায় তিনি দেশে-বিদেশে এখন সর্বাধিক পরিচিতদের মধ্যে একজন অন্তত: এই মুক্তিযুদ্ধেও সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে।

যাঁর কথা বলছি তিনি ডা. মুরাদ হোসেন। বেশ কয়েক বছর যাবত তিনি আমাদেও মন্ত্রীসভার একজন সদস্য- প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। একজন সংসদ সদস্যও সরকারি দলের মনোনয়ন পেয়ে। মন্ত্রী সভার প্রধান বা গোটা সরকার নারী-বান্ধব অন্তত: দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মধ্যে তা দেশ-বিদেশে স্বীকৃত। যদিও নারী সমাজের বহু গুরুত্বপূর্ণ দাবী-দাওয়া আজও পূরণের অপেক্ষায়।

এ হেন সরকারের মন্ত্রী সভায় দিব্যি স্থান করে নিয়েছিলেন মুরাদ। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার নামে ও জয় বাংলা বা বাংলাদেশ চিরজীবী হোক বলতে কদাপি ক্লান্তিবোধ করেন নি। কিন্তু কী দিয়ে কী হলো তা ভাবতেও বিষ্ময় লাগে। নানা সংবাদ মাধ্যমে অজশ্র নারীকে নিয়ে নানা অবাঞ্চিত, অনাকাংখিত, অশ্লীল অশ্রাব্য তিনি বলায়-ভিডিও ক্লিপে তা ধারণ ও প্রচারের সাথে সাথে তা ভাইরাল হয়। জনমত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মুরাদের বিরুদ্ধে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক-তাকে পদচ্যুত করা হোক-প্রচলিত নানা আইনে তাকে গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হোক এমন দাবী ক্রমান্বয়েই জোরদার হয়ে উঠতে থাকে।

অবশেষে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন পদচ্যুত না করে। সবাই জানি পদচ্যুত করার স্পষ্ট অর্থ হলো শাস্তি প্রদান করা আর পদত্যাগ নানাবিধ হতে পারে। যেমন অবস্থার চাপে, বা স্বেচ্ছায় বা শীঘ্রই অন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার কারণে বা অধিকতর যোগ্য কাউকে ঐ পদে অধিষ্ঠিত করার জন্যে। এর যে কোনটাই হতে পারে। যা হোক পদত্যাগ পত্রে মুরাদ লিখলেন, “ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করলাম। যদি এটাকে শাস্তি বলি তবে মানতেই হবে, এটা মৃদু বা নরম একটি শাস্তি।

যা হোক, সবাই মেনে নিয়েছেন এবং মুরাদের পরবর্তী আচরণে বুঝা যায়, তাঁকে শাস্তিই দেওয়া হয়েছে। এ জন্যে কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জাগতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নি। ইউনিয়ন. উপজেলা ও জেলা কমিটি (আওয়ামীলীগের) ডা. মুরাদকে সাংগঠনিক সকল পদ থেকে অবসর দিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করেছেন, মুরাদকে দলীয় সদস্যপদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করে দেওয়া হোক। তবে এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় নি ফলে তাঁর বিষয়টি আলোচনাও হয় নি। তাই নি¤œতর কমিটিসমুহের সম্মিলিত দাবী পূরণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ তাঁর রয়েই গেছে সেটি হলো সংসদ সদস্যেও পদ। যার মেয়াদ আরও দুই বছর বিদ্যমান আছে। এই পদ থেকে পদত্যাগ করতে তাঁকে বলা হয় নি। তাঁকে যদি সংসদে না চাওয়া হয় অর্থাৎ সংসদ সদস্য পদে যদি তিনি অনাকাংখিত হন তবে তাঁকে অপসারিত করতে হবে। সে পথ জটিল। আমাদের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, যদি কোন সদস্য পার্টি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট প্রদান করেন তখন সংসদ স্পীকারকে বলতে পারে তাঁকে অপসারণ করা হোক এবং স্পীকার তা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তেমন কোন ঘটনা অর্থাৎ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটেনি-তাই অপসারণের কোন সুযোগ দেখা যাচ্ছে না।

আর একটি পথ আছে। তা হলো তিনি যদি একাধিক্রমে সংসদের অধিবেশন চলাকালিন ৯০টি দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকেন তবে তাঁর সদস্যপদ থাকবে না এবং ঐ কারণে তিনি আর সংসদ সদস্য নন বলে স্পীকার ঘোষণা দেবেন। দিল্লী বহুত দূও অস্ত। কারণ বর্তমান সংসদের মেয়াদকালের আয়ু যতটুকু বাকী আছে তাতে ৯০ দিন অধিবেশন বসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। করোনা-ওমিক্রম বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা- এ সবই লম্বা অধিবেশনের বিপরীতে। তাই ধরেই নেওয়া যায় ডা. মুরাদের সংসদ সদস্য পদ বর্তমান মেয়াদে অব্যহিতই থাকছে অন্তত: তিনি স্বত; প্রেণোদিত হয়ে যদি পদত্যাগ না করেন।

বাংলাদেশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর হতে না চাইলেও বিদেশীরা দিব্যি দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। বিদেশ-যাত্রা এবং ফিরতি যাত্রা ও ফেরত আমার কাহিনী পড়ে তা দিব্যি উপলদ্ধি করা যায়। পদত্যাগ করার দু’দিন পরে রাতের আঁধারে তিনি রওনা দিলেন বিদেশের উদ্দেশ্যে তবে একা। পরিবার পরিচনকে নিয়ে নয়। রওনা হলেন কানাডা-সেখানে পৌঁছার পর তিনি পড়লেন বিমান বন্দরের নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরের পালায়। অবশেষে ঐ বাহিনী তাঁকে সংসদ সদস্য এবং লাল পাসপোর্ট থাকা সত্বেও ঢুকতে দিলেন না।

ডা. মুরাদ এবার রওনা হলেন দুবাই এর উদ্দেশ্যে। না, সেখানেও যেতে পারলেন না। ফিরতে হলো দেশে রাতের অন্ধকার তা ও আবার ভি.আই.পি. লাউঞ্জ দিয়ে নয় কারণ সেখানে অনেক সাংবাদিক তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই গতি পরিবর্তন করে সাধারণ পথ দিয়ে কালো কাপড়ে মাথার টাক ঢেকে সেখানে অপেক্ষমান এক গাড়ীতে চলে গেলেন।

ডা. মুরাদের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন কি ? না, ঢাকা শহরে তিন তিনটি বাড়ী থাকা সত্বেও তার কোনখানেই তিনি ওঠেন নি। তাঁর বাড়ীর দারোয়ানেরা জানে না তাঁর স্ত্রী সন্তানেরাও জানেন না। তবে তিনি কি আত্মগোপনে গেলেন ? তাতো হওয়ার কথা না। কার ভয়ে তবে বাসায় গেলেন না ? স্ত্রী সন্তানদের ? তবে কি তিনি তালাকে মুখোমুখি হতে চলেছেন ? সন্দেহটা করছি এ কারণে যে তিনি যা করেছেন তা কোন স্ত্রীর বা সন্তানদের কাছে কদাপি গ্রহণ করেন না ?

মামলা নয় কেন ?

লিখিতভাবে না হলেও নারী ঘটিত ব্যাপারকে ডা. মুরাদকে পদত্যাগ করতে সরকারি ভাবেই বলা হয়েছিল। তা করায় ডা. মুরাদ ওই অভিযোগগুলি স্বীকার করে নিয়েছেন। অন্তত: পদত্যাগ তাই প্রমান করে।

তা হলে এর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হাজার হাজার ঘটনা ঘটলেই যেখানে নারী ও শিশু নির্য্যাতন আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে, হাজার হাজার মামলা বিচারধীন থাকছে আবার বহু মামলায় ফাঁসী বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হচ্ছে-সেখানে ডা. মুরাদ এম.পি-ও বিরুদ্ধে সরকারিভাবে তা নেওয়া হচ্ছে না কেন ? এই দাবী বাংলাদেশের নারী সমাজের বাংলাদেশের সকল সুস্থ চিন্তার নাগরিকের।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ নায় কেন ? ডা. মুরাদ অসংখ্য নারীকে উত্যক্ত করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অনেক নেত্রীকে নানাভাবে নির্য্যাতন করেছেন। একজন মহিলাকে পুলিশ দিয়ে এক হোটেলে অনবেন যদি নিজে থেকে মহিলাটি না আসেন বলে হুমকি দিয়েছেন-অপর একজন মহিলার সাথে দীর্ঘ ফোনালাপ যেভাবে ফাঁস হয়েছে তার প্রতিটি ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এক বা একাধিক মোকর্দমা হতে পারে। জনগণের দাবী ও তাই।

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয়, ছলিমুদ্দি-কলিমুদিরা কেউ এর সিকি পরিমান অপরাধ করলে অনেক আগেই জেলে যেতে বাধ্য হতেন- ডা. মুরাদ বলেই কি তা হচ্ছেন না ?

আইনের শাসনের এবং নারী বান্ধবে এই দেশে আইন প্রয়োগে এমন বৈষম্য কেন ? এতে আশ্চয্য না হয়ে পারা যায় না তাই বলি, কিমাশ্চর্য্য অত:পরম।

লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।