রণেশ মৈত্র


ছোটবেলায় খুব আদর পেতাম-সম্মানও পেতাম ছাত্র সমাজের কাছে-ব্যাপক এবং নানা স্তরের মানুষের পঞ্চাশের দশকের কথা। আজ যেন মনে হয় পঞ্চাশের দশকের কথা ভাবলে যে ছবিগুলি আপনা-আপনি চোখের ?  ছিল কি চোখের সামনে ভেসে ওঠা ওই ছবিগুলির মত পূরাপূরি অবিকল? কোন ধনীর ঘরে জন্মগ্রহণ করি নি। পোষকা-আশাকে কেতাদূরস্ত কখনই ছিল না। চেহারাটাও আকর্ষণীয় ছিল না-আজও নেই। তবে এখন যেমন বেদক মোটা ক্রমশ: নিস্তেজ হয়ে পড়ার ও করোনার কারণে দু’বছরের অধিক কাল গৃহবন্দী হয়ে থাকা হাঁটা-চলা , কায়িক পরিশ্রম বন্ধ হয়ে শুয়ে বসে দিন কাটানোর ফলে তখন ছিলাম নেহায়েত পাতলা ও প্রায় ওজনহীন একটা মানবদেহতুল্য। তবুও ভাসতাম সকল মহলের মানুষের আদর, সম্মান, ভালবাসার অতিশয্যে। এও যেন কম বলা হলো সেদিনকার বর্ণনায়।

কী এমন বৈশিষ্ট্য ছিল তা হলে যার জন্যে মানুষ অতটা ভালবাসতেন? কারণটা ছোট্ট। ছাত্র আন্দোলন করতাম-ছাত্র ইউনিয়ন করতাম-ছাত্র ন্যায় সঙ্গত: দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতাম-স্থানীয় পর্য্যায়ের সকল দাবীই প্রায় আদায় করে ছাড়তাম। বিপদে আপদে মানুষের কাছে ছুটে যেতাম-আন্তরিকতা ও মমত্ববোধের মাধ্যমে সেই বিপদ আপদগুলির সাধ্যমত সুরাহা করতাম। সমাজ কল্যাণ মূলক কাজগুলি যতটা সম্ভব করতাম।

এমন সৌভাগ্য কি শুধুই আমার ভাগ্যে জুটেছিল? না, আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, মুহুর্তের জন্যও তা আদৌ ভাববেন না। এ সৌভাগ্য সেদিন জুটেছিল আমার সকল সহকার্মীদের সকল ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের। কিছু কিছু ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরাও। ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম ১৯৫২ সালে মুসলিম ছাত্রলীগের ১৯৪৮ সালে। এ দুটি সংগঠনের জন্মই “ইসলাম কায়েমের লক্ষ্যে মুসলমানদের দেশ-পাকিস্তানের অল্পদিনের ব্যবধানে। কিন্তু ঐ যে, যে লক্ষ্যগুলি, যে আর্শগুলি প্রচার করে “নারায়ে তকবীর” ধ্বনি তুলে মুসলিম লীগ পাকিস্তান কায়েম করেছিল, আমরা ছাত্র ইউনিয়ন ঐ লক্ষ্য ও আদর্শগুলির সাথে একমত তো ছিলামই না-বরং ছিলাম তার বিপরীত। ছাত্রলীগও অনেকটা। ‘অনেকটা’ বলছি, ছাত্র লীগকে হেয় করার উদ্দেশ্যে নয়। তারা ছাত্র ইউনিয়নের তুলনায় জন্মকাল থেকে বেশ কিছুকাল পর্য্যন্ত তাদের সংগঠনের নামে সাথে “মুসলিম” শব্দটি রেখেছিল-অর্থা যেন সংগঠনটি মুসলিম ছাত্রদের-সকল ধর্ম-বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী ছাত্র-ছাত্রীরা নয়।

আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম-তারা লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলাম-ক্লাসে ফার্স্ট, সেকে-, থার্ড অবস্থান সকল পরীক্ষায়ই প্রায় অর্জন করতাম। ছাত্র-ছাত্রীদের হোষ্টেল, পানীয় জল, গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ফ্রি- হাফ ফ্রিশিপ প্রভৃতির জন্য নিষ্ঠার সাথে আন্দোলন করতাম। সে কারণে শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবক অভিভাবকদের সমর্থনও পেয়ে যেতাম স্বত:ষ্ফুর্তভাবে। পরীক্ষার নোটিশ হলেই দেখতাম সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে পরীক্ষা পেছানোর দাবী তুলতো-আমরা ছাত্র ইউনিয়ন তার বিরোধিতা করে বলতাম, পরীক্ষা সময়মত হতে হবে নইলে উচ্চতর শ্রেণীতে গিয়ে কোর্স শেষ করার সময় পাওয়া যাবে না।

কলেজে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ-খেলাধুলা-টুর্নামেন্ট-সব কিছুতে আমরা ছিলাম অগ্রণী। গানে, আবৃতিতে নাট্যাভিনয়ে আমরা ছিলাম সবার শীর্ষে। সেই কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গায় সাইক্লোন হয়ে অনেক ঘর-বাড়ী উড়ে যাওয়া, বহু মানুষের মৃত্যুরও আহত হওয়ার কথা, অনেক মানুষ দিবারাত্র শূন্য আকাশের নীচে ঘাসের উপর শুয়ে অনাহারে দিন কাটানো এমন খবর এলো। দ্রুততার সাথে বৈঠক বসলো ছাত্র ইউনিয়নের জেলা কমিটি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ত্রাণ সংগ্রহ করা হবে মানুষের বাড়ী বাড়ী দোকানে দোকানে অফিস-আদালতে গিয়ে এবং এভাবে সংগ্রহীত ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।

যে কথা সেই কাজ। পরদিন থেকে কয়েক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাড়ী-বাড়ী দোকান পাটে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করা হলো তিন দিন ধরে। চতুর্থ সংগৃহীত কয়েক বস্তা চাল, পুরানা কাপড় প্রভৃতি নিয়ে রওনা হলাম চুয়াডাঙ্গার পথে। ট্রেনযোগে গিয়ে চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশনে নেমে বহু কষ্টে বস্তাগুলি নামিয়ে শুনি সাইক্লোন যে গ্রামে হয়েছে তা অনেক দূরে ষ্টেশন থেকে। খোঁজ করলাম গরুর বা মহিষের গাড়ী পাওয়া যায় কি না। সকলে জনালোওসব পাওয়া যাবে না কারণ রাস্তা নেই। আইল ভেঙ্গে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। উপায়?

ছুটলাম ষ্টেশন মাষ্টারের কাছে। কি করা যায় পরামর্শ চাইলাম তাঁর কাছে। তিনি পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, আমরা পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ত্রাণ সংগ্রহ করে এনেছি কিন্তু দুর্গত এলাকায় সেগুলি নিয়ে যেতে আপনার সাহায্য সহযোগিতা চাই। তিনি বললেন, ছাত্র ইউনিয়ন? তাই তো আপনারা ছুটে এসেছেন। কিন্তু এলাকাটা দূরে হেঁটে যেতে জ্জ ঘন্টা লাগবে। মালামাল নেওয়ার যান বাহন ও রাস্তা না থাকায় পাওয়া যাবে না। বরং আপনারা এগুলি রেখে যান আমার যেভাবেই হোক পৌঁছানোর ব্যববস্থা করবো। আর অল্পক্ষণে মধ্যেই ঈশ্বরদীমুখী ট্রেন আসবে। তাতে করে পাবনা চলে যান। আমরা বললাম, মালপত্র আপনি রাখুন, যত দ্রুত পারেন পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। আর আমরা দুর্গত এলাকায় গিয়ে দেখে আসি। তিনি পথ দেখিয়ে দিলে আমরা হাঁটতে সুরু করলাম। সে হাঁটা আর শেষ হয় না। দুপুর ১২টার দিকে রওনা হয়ে সন্ধ্যে ৬ টার পরে পৌঁছালম। ব্যথায় পা টন টন করছে-ফুলেও গেছে।

যাহোক, জ্যোছনা রাত ছিল। যা শুনেছিলাম, চক্ষুষ দৃশ্যতার সাথে অনেকটাই মিলে গেল। কোন একজন সাহায্যকারী খুঁজতে খুঁজতে তাঁবু খাটানো একটা ক্যাম্প দেখলাম। ব্যানারে লেখা “ভারত সেবাশ্রম সংঘ”। আমাদের স্বজনকে দেখে বসতে বললেন, কোন চিন্তা করবেন না। চুয়াডাঙ্গা থেকে মাল আমাদের ব্যবস্থাপনায় কাল দুপুরের মধ্যেই এনে পৌঁছে দেব। আপনারা বিলি করবেন। আপনাদের রাতের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমরাই করবো। থেকে গেলাম ঐ ক্যাম্পেই রাতটা। দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলির ফাঁক গলিয় ছিটিয়ে পড়া চাঁদের আলোয় ঘুরে ঘুরে দেখলাম যেন একটা ধ্বংসস্তুপ। গ্রামটির পাশ দিয়ে ছোট একটা নদী ছিল-জলের বেশ গভীরতা ছিল। নদীটার সমস্ত জল ঝড়ে কাদামাটি সহ উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে-কোথায় তা কেউ জানে না। জলশূন্য নদীটি যেন হতাশায় মুষড়ে পড়ে আছে। এইসব দেখে খেয়ে দেয়ে রাতে সামান্য ঘুমিয়ে পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ক্যাম্প কর্মকর্তাদেরকে বললাম আমরা ফিরে যাচ্ছি। ত্রাণের বস্তা কয়টি আনিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গরীব লোকদের মধ্যে বিলি করে দেবেন। ওঁরা বললেন, রাজী আছি তবে কাদেরকে দেবো সেই তালিকাটি তৈরী করে দিয়ে যান। বিলির পর ডাকযোগে তালিকাটি পাঠালে খুশী হবো। এই বলে তাঁদের খাতায় ঠিকানা লিখে দিয়ে যান। বিলির পর ডাকযোগে তালিকাটা খাতায় ঠিকানা লিখে দিয়ে চলে এলাম।

পাবনা শহরে কলেরার মহামারি দেখা দিল। মানুষ ভয়ে সন্ত্রস্ত-ওষুধ নেই, ডাক্তার আসতে চায় না বলে হাসপাতালে পাঠাম সেখানেও ঠাঁই নেই। লোকে এলো আমাদের কাছে কিছু একটা বরুণ। আমরাও ভাবছিলাম কিছু একটা করতে হবে। এক ডাক্তারের কাছে পরামর্শ চাইলাম কলেরা রোগীর নার্সিং করতে কি কি করতে হবে। তাঁরা বললেন রোগীর কাছে যাঁরা যাবেন-তাঁরা হাতে গ্লাভস পরে যাবেন-রোগীর মলূত্র সাবধানে নিয়ে দূরে ফেলে পুঁতে রাখবেন বাড়ীর প্রতিটি ঘরে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জল ছেটাবেন-অবরত হাতে সাবান মাখবেন। কাজ শেষে বাড়ী ফিরে স্নান করে বাড়ী ফিরবেন-শুকনো কাপড় পরবেন। অত্যন্ত সাবধানে কাজগুলি করবেণ। তম্বাস্ত। ৪টা গ্রুপে আমরা বিভক্ত হয়ে ৪টা এলাকায় ত্রাণ কাজ করলাম। রোগী কেউ মারা গেল না আমাদের শুশ্রুষা যাঁরা পেলের তাঁদের মধ্যে।

পৌরসভার নির্বাচন এলো। আমরা কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে বসে আছি। তাঁদের প্রস্তাব নির্বাচনে আমরা যেন প্রার্থী হই তা হলে তাঁরা নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারবেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বললেন, আমরা আপনাদের কাজ দেখে বুঝেছি, আপনারা নির্বাচিত হলে পৌরসভার উন্নয়ন হবে-দুর্নীতি দূর হবে। তাঁদেরকে ধন্যবা জানিয়ে বললাম তাঁরাই যেন বেছে ভাল মানুষদেরকে নির্বাচনে দাঁড়করান আমরা তাঁদের পক্ষে প্রয়োজনে কাজ করাে। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রদের সংগঠন-তারা নিজেরা নির্বাচন করবে না নীতিগত ভাবেই।

একবার আমন্ত্রণ পেয়ে বড্ডা (ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে) গেলাম দু’দিনের জন্য। তাঁরা সেখানে গরীব ছেলেমেয়েদের জন্য ৫টি প্রাইমারি স্কুল খুলেছেন। টিউশন ফি ও বই ছাত্র ইউনিয়ন বহন করতো না। সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলি অধিগ্রহণ করে নি-বিনামূল্যে বই সরবরাহ করতো না। তাই গরীব ছেলে মেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পেত না শিক্ষককতাও করতা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-নেত্রীরাই। স্কুলগুলি পরিদর্শনের বার কর্মী সভা ও ছাত্র জনসভার ব্যবস্থা ছিল। সব কর্মসূচী অত্যন্ত সফল হলো। ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা সেখানে লি ঈর্ষনীয়। কলেজ সংসদে বরাবর ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত প্রাথীরা বিজয়ী হতো। শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমর্থন ছিল বিপুল।

ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি

উপরের বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে ছাত্র ইউনিয়ন বুঝি একটা সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। না আদৌ তা নয়। ছাত্র ইউনিয়ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন হিসেবে তার সুষ্পষ্ট রাজনীতি ছিল। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সর্বপ্রকার শোষণ বিরোধী, দারিদ্র-বেকারত্বমুক্ত গণতান্ত্রিক পাকিস্তান গঠনের দাবীতে আন্দোলনকরতো। তবে কোন রাজণৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তি করতা না ছাত্র ইউনিয়ন। নীতি ও আদর্মের সাথে মিল থাকা ন্যাপ তখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি-কমিউনিষ্ট পার্টি ছিল বে-আইনী। তাই ঐ পরিস্থিতিতে কখনও এককভাবে, কখনও যৌথভাবে আবার কখনও বা আওয়ামী লীগের সাথে প্রবল গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছে ছাত্র ইউনিয়ন সমগ্র প্রদেশ জুড়ে। বললে অত্যক্তি হবে না যে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বিকাশে ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সঙ্গে ছিল পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ। আওয়ামী মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ তুলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করতে ছাত্র ইউনিয়নের প্রচ- চাপ দেওয়া হতো ঐ দুটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপর। সামরিক জাস্তা ও সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সাথেও ছাত্র ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। অনেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং ১৯৫৭ তে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে বিপুল ভূমিকা পালন করেন। যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতায় বসানোর আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদ, ডাকসু ও অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ঐ সময়ে সর্বত্রই প্রায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করতো কয়েকটি বছর ধরে। পরিস্থিতি অবশ্য উল্টে গিয়েছিল ষাটের দশকে ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচণ্ড ঢেউ এর ফলে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরও বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নে। বাম রাজনীতির নানা বিভক্তি ও দুর্বল সংগঠনে পরিণত হওয়ার কারণে আজ ছাত্র ইউনিয়নের অস্তিত্ব দৃশ্যমান নয়। জিয়া-খালেদা জিয়ার আমলে পাকিস্তানের মোনেম খাঁর আমলের মত টাকা ও অস্ত্রের ঝনঝনানি নিয়ে ছাত্র দল নামে নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠলো। তারা অবশ্য পরবর্তীতে এরশাদ আমলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে মিলিত হয়ে। অত:পর খালেদা জিয়ার শাসন এবং সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু বৃহত্তম নয় একক ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। আজও সেই অবস্থা বিদ্যমান।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে লেখা আছে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি। এই তিনটি তাদের মূলমন্ত্র। তারা পাকিস্তান আমলে আন্দোলনও করেছে এই তিনটিকে ধারণ করে। তাদের সেই অবস্থানটি তাদের মূল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এক যুদ ধরে একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকার পরও তাদের নৈতিক এবং আদর্শিক ভূমিকা অতীতের মত উজ্জ্বল। আজ তাদের হাতে অস্ত্র ও কালোটাকা, দলবাজি, টে-ারবা গেলেও সাংগঠনিক পদে সম্মানীয়, নারী লোলুপতা সংগঠনটিকে কুঁকড়ে কুঁকড়ে খেয়েছে। এই অভস্থা থেকে ডেনে তুলে সংগঠনটিকে তাদের আগের গৌরবোজ্জ্বল পথে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব কারণ-

এক. সাংগঠনিক ঐক্য ও শৃংখলা নেই।

দুই. এক এক নেতা এক এক গ্রুপ পরিচালনা করে।

তিন. স্তাবকতায় গা ভাসিয়েছে সংগঠনের নেতারা।

চার. জনজীবনের সমস্যা সংকট নিয়ে আন্দোলনের পরিবর্তে উন্নয়নের ফোয়ারা তাদের মুখে মুখে ব্যক্তিস্বার্থ
ফুটছে অনবরত।

পাঁচ. আওয়ামী লীগ নেতারা অনেকেই নিজ নিজ স্বার্থে ছাত্র লীগকে নানা গ্রুপে নানা এলাকায় বিভক্ত করে
ফেলেছেন তাঁদের বিশেষ বিশেষ স্বার্থের পাহারাদারের মত করে।

ছয়. ছাত্র সমাজের কাছে আদৌ কোন জবাবদিহিতা নেই।

পরিত্রাণের পথ

পাকিস্তান আমলের গণ আন্দোলনও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সামাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ব্যতীত মুক্তিযদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল না। এহেন ছাত্র সংগঠনগুলিকে যদি আজ আবার তাদের আদর্শিক ভূমিকা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল না। এহেন ছাত্র সংগঠনগুলিকে যদি আজ আবার তাদের আদর্শিক ভূমিকায় ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে কোন ক্রমেই দেশের ভবিষ্যত সৎ যোগ্য ও সাহসী নেতৃত্ব গড়ে তোলা যাবে না। দেশটি অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ারও আশংকা রয়েছে উপুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্যতায়।

সারা দেশে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ সমূহের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বেহাল অবস্থা, তাদের একাধিক প্রার্থী দাঁড়ানো, সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়া-তারই ইঙ্গিত বহ। জরুরী প্রয়োজন

এক. ছাত্র সমাজের কাছে তাদের জবাবদিহিতা কাঠগড়ায় যাতে দাঁড়াতে হয় এবং ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য
নেতৃত্ব যাতে গড়ে ওঠে-তার জন্যে অবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং

দুই. হাজারো অপরাধে জড়িতদের অবিলম্বে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে

তিন. কোন ছাত্র সংগঠনে অছাত্র সদস্য ছাত্র-ছাত্রীকে সদস্য বা কর্মকর্তা পদে রাখা যাবে না।

চার. দলীয় লেজুড়বৃত্তির হাত থেকে ছাত্র সংগঠন গুলিকে রেহাই দিতে হবে এবং

পাঁচ. শিক্ষা সমস্যা ও জাতীয় সংকট প্রতিরোধই তাদের জীবনী হিসেবে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।