আবীর আহাদ


বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে ৩০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে 'বীর নিবাস' করে দেয়ার লক্ষ্যে যে প্রকল্প অনুমোদন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে তা কোনো মতেই বাস্তবসম্মত নয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সিংহভাগ অর্থই ঠিকাদার ও অন্যান্য সুযোগ সন্ধানীচক্রের পেটে চলে যাবে... ফলে গোঁজামিল দিয়ে তৈরি জরাজীর্ণ ও নড়বড়ে বীর নিবাস অল্পদিনের মধ্যেই বসবাসকারীদের জন্য অভিশাপ ডেকে আনবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব বীর নিবাস তৈরি হচ্ছে, তার ভগ্নদশাদৃষ্টে সে অভিশাপেরই ইংগিত দিচ্ছে। এটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বেদনাদায়ক তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। দেশের ৯০% শতাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন।

এ অবস্থায় ঐ তথাকথিত ৩০ হাজার বাড়ি কারা কীভাবে পাচ্ছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাছাড়া এই বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে সেজন্য কতোটি বছর অতিবাহিত হবে এবং ততোদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কিনা তা কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছেন? এ-ব্যতীত প্রত্যেক উপজেলায় প্রকৃত গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বীর নিবাস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বছর ১৪ হাজার বীর নিবাস নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণীর প্রতারকচক্র স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে পর্দার অন্তরালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে! এ-প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃতই গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়, বাড়িগুলো পাচ্ছেন টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক সংযোগের অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে ১৪ হাজার তথাকথিত সরকারি বীর নিবাস প্রাপকদের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছে তার মধ্যে উপরোক্ত আশংকার সত্যতা পাওয়া গেছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা সরকার এ পর্যন্ত যতোগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কী পরিমাণ বাস্তবায়ন ঘটেছে তা কেউ না জানলেও আমরা মুক্তিযোদ্ধারা জানি। ইতিপূর্বেকার নানান গালভরা কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতিটি বক্তব্য ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বুঝা উচিত, বীর মুক্তিযোদ্ধারদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে দেশটি স্বাধীন হয়েছে বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন। অতএব জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকেই সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়াদের উচ্ছেদ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে ; তাদের গৃহ, চিকিত্সা, সামাজিক নিরাপত্তাসহ তাদের ন্যূনতম আর্থসামাজিক উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এসব মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আমরা ইতিমধ্যে ৮ দফাভিত্তিক একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেছি। দেশের সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাক্ষর নিয়ে আমরা সেটি আসছে স্বাধীনতা দিবসের আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশ করতে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যে সারা দেশের জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ ও মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একটা স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করছেন।

উক্ত স্মারকলিপিতে অন্যান্য বিষয়সহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বেকার সন্তানদের বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি চাকরি প্রদান, প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের মাসিক সম্মানী থেকে ন্যূনতম কিস্তিতে ঋণের অর্থ কেটে নেয়ার শর্তে এককালীন বিনাসুদে সুদে ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদানের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিতকালের মধ্যেই করতে হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর তেমন বেশি দিন থাকবেন না। এছাড়া আগের তথাকথিত ১৪ হাজারসহ বর্তমানের ৩০ হাজার বাড়ি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে চরম রেষারেষি ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই তো এ-সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী। অধিকাংশেরই গৃহ দরকার। সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ ছোটো বা কেউ বড়ো মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই। সবাই মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি দিতে হলে সবাইকে দিন, অন্যথায় এ অবাস্তব দুর্নীতিগ্রস্ত জগাখিচুড়ি ও হানাহানিপূর্ণ পরিকল্পনা বাদ দিন। তারচে' ভালো, একই ডিজাইনের নির্দেশনার আলোকে সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন। যার প্রয়োজন সে ঋণ নেবে অথবা নেবে না। এতে সবাই একটি সান্ত্বনা পাবে। খয়রাতির বদনাম থেকে তারা কিছুটা মুক্তি পাবেন। কোনো মন খারাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, হবে না কোনো হানাহানি। অপরদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপীও হবে না। কারণ তারা ঋণ নেবে তাদের ভাতার বিপরীতে... যে ভাতাটি সরকারেরই হাতের মুঠোয়...ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা... কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিশেবে পরিগণিত হবে। সুতরাং সরকারের কাছে আমার আবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে, তাদের মনে ব্যথা না দিয়ে, অবিলম্বে তথাকথিত বীর নিবাস প্রকল্পের বাইরে অবস্থানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গৃহঋণের সুব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এতে চিরবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের বেদনার্ত বুকে একটা অপার শান্তি ও সান্ত্বনা বয়ে আনবে।

লেখক : গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।