রণেশ মৈত্র


বীর মুক্তিযোদ্ধা গীতা তালুকদার জন্মগ্রহণ করেন রাজশাহী জেলার শেখপাড়া গ্রামে। ১৯৪৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা প্রয়াত সুধীর নাথ তালুকদার ছিলেন একজন জমিদার। এক পর্য্যায়ে গ্রাম থেকে তিনি সপরিবারে নাটোর শহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। গীতা তালুকদারের মা প্রয়াত শিশির কণা তালুকদার ছিলেন গৃহিনী এবং অত্যন্ত সদালাপী।

গীতা তালুকদার নাটোর শহরে এসে সেখানকার সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৯ সালে পাবনার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক রণেশ মৈত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান আমলে তাঁর স্বামী দফায় দফায় দীর্ঘ মেয়াদে কারারুদ্ধ হওয়ায় সন্তানদের সহ তিনি এক গভীর সংকটে নিপতিত হন। এই সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি পাবনা সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বাংলায় এম.এ ফার্স্ট পার্ট পাস করার পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে এম.এ. ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেন নি।

১৯৭১ সালে পাক-বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে পাবনা এসে পড়লে ছাত্র লীগ। ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তৎকালীন পাবনার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট নূরুল কাদের সমবায়ে গঠিত হাই কম্যান্ডের নেতৃত্বে অমন সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে ২৯ মার্চ পাবনা প্রথম দফা স্বাধীন হয় পাবনাতে আগত ২০০ পাক-সেনাকে হত্যা করে।

অত:পর হাইকম্যা- গীতা তালুকদারের স্বামী ন্যাপ নেতা রণেশ মৈত্র ও আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আমজাদ হোসেনকে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে সেখানকার সরকারের কাছ থেকে পাবনা জেলার তরুণ তরুণীদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বেশ কিছু ভারী অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষক নিয়ে আসার দায়িত্ব অর্জন করলে তিনি গীতা তালুকদার ও সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে গন্তব্যস্থ না জানিয়ে গ্রামে এক পরিচিত ব্যক্তির বাড়ীতে তাঁদের কে রেখে কলকাতা চলে যান। সেখঅনে তাঁরা পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর সাথে দেখা করে গোটা পরিস্থিতি অবহিত করলে তিনি বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভূক্ত হওয়ায় দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের আস্বাস দিয়ে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে বলেন। দিল্লীর জবাব আসতে সপ্তাহ খানেক দেরী হয়।

ইতোমধ্যে পাবনার দ্বিতীয় দফা পতন হলে রণেশ শৈত্র দেশে না ফিরে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের তরুণদের রিক্রুট করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে ফিরে যাতে পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে পারে সেই লক্ষে পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার করিমপুরে একটা রিক্রুটিং ক্যাম্প বা যুব শিবির গড়ে তুলে নয় মাস ব্যাপী তার পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।

অপরদিকে দেশের অভ্যন্তরে থেকে চারটি সন্তান নিয়ে গীতা তালুকদার গ্রামে গ্রামান্তরে ছুটতে থাকেন তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে। অপরদিকে যখন গ্রামেই থেকেছেন সে গ্রামেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের আহারাদি ও থাকার ব্যবস্তার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এভাবে প্রায় ছয় মাস অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে আর থাকার মত পরিস্থিতি না থাকায় রণেশ মৈত্রের একজন বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী আনোয়ারুল হকের পরামর্শে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। প্রায় ১২/১৩ দিন ধরে হাঁটাপথে, কখনও বা নৌকায়, কখনও বা অন্য যানবাহনের সাহায্যে পশ্চিম বাংলায় গিয়ে আওয়ামী লীগ পরিচালিত কেচুয়া ডাঙ্গা যুব শিবিরে উস্কো খুশকো বেশে চারটি শিশু সন্তান সহ গিয়ে হাজির হন। ঐ ক্যাম্পের পরিচালক একজন এম.পি (তফিজ উদ্দিন) ও ডা. পরিতোষ সাহা মঞ্জু নামক এক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীকে সাথে দিয়ে তাঁর স্বামী রণেশ মৈত্রপরিচালিত করিমপুর ক্যাম্পে পৌছে দেন।

অতঃপর গীতা তালুকদারকে কলকাতা রেখে আসেন। তাঁর স্বামী রণেশ মৈত্র। সেখানে সুস্থ ছওয়ার পর মাস খানেকের মধ্যেই করিমপুরে ক্যাম্পে গিয়ে রণেশ মৈত্র ও কমরেড প্রসাদ রায়ের সাথে মিলিত হয়ে করিমপুর ক্যাম্পে তাঁদের সহযোগি হিসেবে তিন মাস অবস্থান করে গীতা তালুকদার ক্যাম্পে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচর্য্যা ও সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্ব পালন করেন। এভাবেই গীতা তালুকদার কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মুক্তি যুদ্ধের কাজে অবদান রাখেন।

১৯৭২ এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনি সপরিবারে পাবনা ফিরে আসেন। অত:পর বাংলাদেশ সরকার গীতা তালুকদারের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেব গেজেটভূক্ত করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা গীতা তালুকদার বিয়ের পর পূরবী মৈত্র হিসেবে পরিচিত হন। বর্তমান তিনি ও তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা পাবনা শহরের বেলতলা রোডে একটি অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি বাড়ী লিজ নিয়ে বসবাস করছেন।
ষাটের দশকে রণেশ মৈত্র বারংবার কারারুদ্ধ হওয়ায় পাকিস্তান অবজার্ভারের বার্তা সম্পাদকের অনুরোধে কিছুকাল ঐ পত্রিকার পাবনাস্থ সংবাদ দাতা হিসেবেও কাজ করেন।

১৯৭৩ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধ গীতা তালুকদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং ২৭ বছর চাকুরী করার পর অবসর গ্রহণ করেন। গীতা তালুকদার “চির বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা” নামে একটি কাব্য গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮০।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।