স্টাফ রিপোর্টার : চাঁদপুরে বিআরটিএ’র অফিস কাম মোটরযান চালনা পরীক্ষণ এবং বহুমুখী কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত জমি নিয়ে চরম বিরোধ, আপত্তি ও মামলা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অধিগ্রহণের টাকা গ্রহণের অপেক্ষায় আছেন জমির মালিকানা দাবিদাররা। অথচ তাদের মালিকানা নিয়ে আছে চরম বিরোধ। মৃতব্যক্তিদের থেকে জাল দলিলের মাধ্যমে জমির মালিক বনে যান প্রভাবশালী চক্রটি। তারা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করছে টাকা দেয়ার জন্যে। কিন্তু বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে না এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং সেন্টার বদ্ধ গ্রামের ভেতরে হোক। এ জায়গাটি গ্রামীণ জনপদের ভেতরে তো বটেই, সেখানে বড় ধরনের গাড়ি যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই। আছে গ্রামে ঢোকার সরু গলিপথ। এমন একটা অনুপযোগী জায়গায় হতে যাচ্ছে বিআরটিএ ট্রেনিং সেন্টার। এই বিরোধপূর্ণ এবং একেবারেই অনুপযোগী জায়গাটা হচ্ছে সাবেক মৈশাদী ইউনিয়ন বর্তমান চাঁদপুর পৌরসভার ১৩নং ওয়ার্ডস্থ খলিশাডুলি মৌজার পালকান্দি এলাকায়। যেখানে মোটরযান ফিটনেস টেস্ট, মোটরযান চালকদের প্রশিক্ষণ এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে।

অভিযোগ রয়েছে, মৌজামূল্য এবং বাজারমূল্যের চেয়েও অধিক উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এই বিআরটিএ ট্রেনিং সেন্টারের জন্যে নির্ধারিত ৩ একর ৩৯ শতাংশের বিরোধপূর্ণ জমির জন্যে। এতোটা অনুপযোগী ও বিরোধপূর্ণ জমি হওয়া সত্ত্বেও এই জমির মালিকানা দাবিদারদের ক্ষতিপূরণের জন্যে ৩৮ কোটি ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৫ টাকা প্রাক্কলন প্রেরণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দপ্তরে। আর এতো অনিয়ম হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ নেতার প্রভাব ও হস্তক্ষেপে। এতে লাভবান হচ্ছেন সেই নেতা এবং তাঁর পরিবার। ওই শীর্ষ নেতার স্ত্রী এবং তাঁর আপন ভাইয়ের নামে এখানে ৭০ শতাংশ জমি লীজ ছিলো। পরবর্তীতে তাঁরা অধিগ্রহণ করা হবে জানতে পেরে এই জমি হস্তান্তর করে দেন এবং মরণ পাল গংয়ের নামে এই ভিপি লীজি সম্পত্তি অবমুক্ত করে দেয়ার কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। আর অবমুক্ত করতে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের নামেও দলিল করা হয়েছে। আর এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন প্রভাবশালী ওই নেতা। বিনিময়ে অধিগ্রহণের টাকা থেকে ভালো লাভবান হবেন এ আশায়। আর এ ধরনের একটা গোপন চুক্তি হয়েছে পুরো বিষয়টির কারিগর সোহেল গাজীর সাথে। মৃতব্যক্তিদের নামে জাল ও ভুয়া দলিল সৃজন করার অভিযোগ এই সোহেল গাজী এবং মরণ পালের বিরুদ্ধে।

চাঁদপুর শহর থেকে একটু পূর্বদিকে টেকনিক্যাল স্কুলের পশ্চিম পাশ এবং বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির এরিয়ার গেটের পাশ দিয়ে একটি গ্রামীণ সরু পথ গেছে ভেতর দিকে। প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে হচ্ছে বাহের খলিশাডুলি গ্রাম। এই গ্রামের একটি এলাকা হচ্ছে পালকান্দি। যেখানে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে বড় কোনো গাড়ি যাওয়ার মতো কোনো সড়ক নেই। রিকশা ও অটোবাইক চলাচল করে এই গ্রামীণ সড়ক দিয়ে। এছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করার মতো কোনো পথ এখানে নেই। রাস্তা দুই পাশে প্রশস্ত করার মতোও কোনো জায়গা নেই। এই রাস্তা দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে হচ্ছে খলিশাডুলি মৌজার পালকান্দি গ্রাম। এই গ্রামের রামচন্দ্র পাল গংয়ের প্রায় ৬ একর সম্পত্তি বহু বছর যাবত ভিপি হিসেবে রেকর্ড হয়ে আছে।

জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এরা দেশ ছেড়ে ভারত চলে যায়। এই ভিপি সম্পত্তি কোনো কোনো সময় পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা লীজ নেন। এসব লীজ চলাকালে নানা মারপ্যাঁচে কিছু দুষ্ট লোক ঢুকে যায়। তারা নিজেদের নামে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু সম্পত্তি লীজ নেয়। আর তাদেরকে বিপদমুক্ত রাখার জন্যে শহরের প্রভাবশালী পরিবারের সরকার দলীয় এক শীর্ষ নেতাকে এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এই নেতা আবার নিজেকে বিতর্ক থেকে মুক্ত রাখার জন্যে তিনি নিজের নামে না নিয়ে তাঁর স্ত্রী ও আপন ছোট ভাইয়ের নামে ৭০ শতাংশ জমি লীজ নেন। এরই মধ্যে চাঁদপুর জেলায় বিআরটিএ’র একটি ট্রেনিং সেন্টার করার বিষয়টি আলোচনায় আসে। যেখানে মোটরযান ফিটনেস টেস্ট, মোটরযান চালকদের প্রশিক্ষণ এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। এর জন্যে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা যখন দেখা দেয়, তখনি সরকার দলের জেলার ওই শীর্ষ নেতা জানতে পারেন। আর তখনি তিনি খলিশাডুলি মৌজার পালকান্দি গ্রামের ওই জায়গাটি অধিগ্রহণের জন্যে সব ধরনের চেষ্টা করতে থাকেন। জমির পরিমাণ হচ্ছে ৩.৩৯ একর।

এদিকে এই জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। যখন অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন এলাকার আলাউদ্দিন খান গং আদালতে মামলা করেন। সে মামলা চলমান অবস্থায়ই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এক্ষেত্রে প্রভাব খাটান ওই নেতা। প্রক্রিয়া বহু দূর এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে আলাউদ্দিন গং মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন (নং ৪৭৯, তারিখ ৯/১/২২) দাখিল করেন। এই পিটিশনের উপর ভিত্তি করে ২৩/১/২০২২ তারিখে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পুরো সম্পত্তির উপর ঝঃধঃঁং য়ঁব তথা স্থিতাবস্থার আদেশ দেয়। এই আদেশের ফলে এখন কিছুটা বিপাকে পড়ে গেছে ওই দুষ্ট চক্রটি।

আলাউদ্দিন খান জানান, আমি উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশের সার্টিফাইড কপি চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে গত ৬ ফেব্রুয়ারি পৌঁছিয়েছি। এরপরও শুনছি তারা আদালতের এই আদেশের তোয়াক্কা না করে অধিগ্রহণের টাকা নিয়ে যাবে।

এদিকে এমন একটি বদ্ধ গ্রামের ভেতরে একেবারেই অনুপযোগী এবং বিরোধপূর্ণ জায়গায় জেলার বিআরটিএ’র ট্রেনিং সেন্টার ও বহুমুখী কেন্দ্র স্থাপন না করার জন্যে এর সংশ্লিষ্টরা সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। জেলার এমন একটি প্রতিষ্ঠান মহাসড়কের পাশে হওয়াটাই উপযোগী বলে মনে করেন চাঁদপুরবাসী।

(ইউ/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২)