সৈমন্তী : কয়েক দশক আগেও লক্ষাধিক রাখাইনের পদচারণায় মুখরিত ছিল যে জনপদ, সেই এলাকায় রাখাইনদেও সংখ্যা বর্তমানে মাত্র আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। পটুয়াখালি বরগুনা এলাকায় সপ্তদশ শতকের শুরুতে প্রথম বসতি গড়তে যারা বনজঙ্গল কেটে আবাদি জমি তৈরি করে সেই অঞ্চলকে বসবাসযোগ্য করেছিল,সেই রাখাইন জনগোষ্ঠী এখন  বিলুপ্ত হবার পথে। পটুয়াখালী ও বরগুনা রাখাইন আদিবাসীদের বসতভিটা, ভূমি, উপসনালয় ও শ্মশান দখল হয়ে যাচ্ছে।

নাগরিক প্রতিনিধি দল বিভিন্ন পাড়ার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন রাখাইন জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বয়স্ক ভাতা, বিধাব ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধী ভাতার কোনোটিই পান না। এছাড়া টিআর কর্মসূচি, কাবিখা, কাবিটা, রাস্তাখনন কোনো কার্যক্রমেই তাদের অর্ন্তভূক্ত করা হয় না। সকলেই এলাকায় রাখাইনদের উন্নয়ন ইস্যুকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এমন অভিযোগ করলেন নাগরিক প্রতিনিধিদল।

১৯৪৮ সালে পটুয়াখালিতে ১৪৪টি ও বরগুনাতে ৯৩টি রাখাইনপাড়া ছিল, বর্তমানে সেখানে যথাক্রমে ২৬টি ও ১৩টি পাড়া টিকে আছে। কতটা অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও ভূমিদস্যুতার শিকার হলে মানুষের সংখ্যা এমনভাবে কমে যায় এটি তারই দালিলিক প্রমাণ। শতাব্দী প্রাচীন কুয়াকাটা বৌদ্ধবিহারের ৯৯ শতাংশ জমির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। দখলদারী ভূমিকা থেকে স্থানীয় প্রশাসনও বাদ যায়নি, স্থানীয় পৌরভবনের প্রস্তাবিত ভবন নির্মাণের জন্য বৌদ্ধ বিহারের জায়গা দখল করা হয়েছে। আমরা জানি দেবোত্তর সম্পত্তি কখনো বিক্রয়যোগ্য নয়, কিন্তু প্রভাবশালীরা এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজশে মিথ্যা দলিলের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে রাখাইনদের পবিত্র উপাসনালয়ের জমির অনেকাংশ। জানা গেছে, ১৯০৬ সালে এ এলাকায় ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার ছিলো, সেখানে আজ এখানে ১টি মন্দির কোনোভাবে টিকে আছে। চুরি হয়ে গেছে ভগবান বুদ্ধের পিতল, পাথর, কাঠ ও চুনাপাথরে নির্মিত মূর্তি। অধিকাংশ বুদ্ধমূর্তি চুরি হয়েছে ২০০১ সালে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাখাইনদের স্থানীয় ভাবে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের বাইওে রাখা হয়। বেসরকারি সংস্থাদের উদ্যোগে রাখাইন শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশুনা, ভূমি আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ (যেগুলি সাইক্লোন সেন্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় ), শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং ভূমি বেদখল হওয়া ভুক্তভোগীদের জন্য আইনী সহায়তা প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তারা। তবে দীর্ঘদিন ধরে রাখাইনরা যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে কেবল দু-একটি উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা এর পাশাপাশি এলাকায় কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুদৃষ্টি কামনা করেন নাগরিক সমাজের সংগঠকেরা।

পটুয়াখালী ও বরগুনার রাখাইন জনপদ সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দল এর উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান, বাংলাদেশ অবজারভারের বিশিষ্ট সাংবাদিক সালিম সামাদ,চলচ্চিত্র নির্মাতা রাশেদ রাইন ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষক অনুরাগ চাকমা,বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা প্রমুখ। সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দলের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসীদের অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিলুপ্ত প্রায় রাখাইনসহ বাংলাদেশের আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো এবং আদিবাসীদের দুঃখ-দুদর্শা জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত ১৩ দাবি বাস্তবায়ন ছাড়াও আদিবাসীদের মধ্য থেকে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষনের জন্য প্রশাসনে একজন আদিবাসীকে নিয়োগের দাবি জানান সৈয়দ আবুল মকসুদ।

মূল বক্তব্যে রোবায়েত ফেরদৌস জানান , পটুয়াখালী ও বরগুনা রাখাইন আদিবাসীদের বসতভিটা, ভূমি, উপসনালয় ও শ্মশান দখল হয়ে গেছে। রাখাইনদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ঘটনাবলী সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য ঢাকা থেকে একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল গত ১২ থেকে ১৪সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাখাইন অধ্যুষিত অঞ্চল বরগুনার তালতলি উপজেলা ও পটুয়াখালির খেপুপাড়া উপজেলার বিভিন্ন রাখাইনপাড়া সরেজমিন পরিদর্শন করেন।

রাখাইন অধ্যুিষত গ্রাম-স্থাপনার নাম পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ‘ইসলামিকরণের রাজনীতি’ চলছে, তা বন্ধ করা, রাখাইনদের জমি বাঙালিদের কাছে বিক্রি বন্ধে প্রজাসত্ত্ব আইন-১৯৫০-এর কঠোর প্রয়োগ, যে সব রাখাইনপাড়ার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে আবার পূর্বের রাখাইন নামে চিহ্নিত করা,স্থানীয় সরকারের সকল স্তরে রাখাইন জনগণের প্রতিনধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ , রাখাইনদের দখলকৃত ভূমি, উপাসনালয় ও শ্মশান দখলমুক্ত করা, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং ভূমিদস্যু ও দখলবাজদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ, কুয়াকাটা পৌরসভার ১৮ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা কমিটিতে কমপক্ষে ৩ জন রাখাইন আদিবাসীদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং পটুয়াখালী-বড়গুনার রাখাইন বসতি রয়েছে এমন সব স্থানীয় সরকারের সকল স্তরে রাখাইন জনগণের প্রতিনধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ, রাখাইন ভাষারক্ষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অবিলম্বে রাখাইনভাষায় শিশুশিক্ষা কার্যক্রম শুরু এবং বিদ্যালয়সমূহে রাখাইন শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ প্রদান, মৃতদেহ সৎকারের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জায়গা বরাদ্দ, সমতলের আদিবাসীদের ভূমিরক্ষার লক্ষ্যে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, সরকারের কুয়াকাটা মাস্টার প্ল্যানে রাখাইন গ্রামকেও অন্তর্ভূক্ত করা, পটুয়াখালী ও বরগুনায় বসবাসরত অবশিষ্ট আড়াই হাজার রাখাইনকে রাষ্ট্র ও সরকারকে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান এবং এই অঞ্চল থেকে যেন রাখাইন মানুষেরা চিরতরে হারিয়ে না যান তার নিশ্চয়তা প্রদান করার দাবিসহ ১৩টি দাবি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।

নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পটুয়াখালী-বরগুনায় রাখাইন আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনাবলী পরিদর্শনের জন্য নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস; চলচ্চিত্র নির্মাতা রাশেদ রাইন; অবজারভার-এর বিশেষ প্রতিনিধি সালিম সামাদ, আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা, অবজারভার-এর ফিচার প্রতিবেদক আসমাউল হুসনা, ভোরের কাগজের প্রতিনিধি তানভির আহমেদ, বিডিনিউজ২৪.কম-এর প্রতিবেদক আশিক হোসেন, বাংলানিউজ২৪.কম-এর প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম সাগর, আইইডির প্রকল্প সমন্বয়কারী সুবোধ এম বাস্কে। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে নুমান আহমেদ খান, রাশেদ রাইন, অনুরাগ চাকমা ও সালিম সামাদ বক্তব্য রাখেন।

(এএস/সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪)