অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : তিন বছরের উপজেলা কমিটির কর্মকাণ্ড চলেছে ১৮ বছর ধরে। আর তাই দীর্ঘ দেড়যুগ পর আগামীকাল শনিবার (১৯ মার্চ) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলন। সম্মেলনকে সামনে রেখে দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকের মধ্যে আবার অজানা আশংকা কাজ করছে। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা চাচ্ছেন দলের জন্য নিবেদিত ত্যাগী নেতারা নেতৃত্বে আসুক। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সম্মেলন ছাড়া একছত্র আধিপত্য বিস্তার করা বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের স্থানে নতুন নেতৃত্ব এখন সময়ের দাবী বলে তৃনমূলে রব উঠেছে। বিশেষ করে সম্মেলনকে সামনে রেখে ৩ বছর মেয়াদে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শাহাজান আলী ১৮ বছর দায়িত্ব থাকার পর আবারো তিনি প্রার্থী হচ্ছেন। এই বিষয়টি নেতা-কর্মীদের মাঝে বেশী আলোচিত হচ্ছে।

দলীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ৪ই আগষ্ট কোটচাঁদপুর উপজেলা আওমীলীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন কালু যশোরের প্রতিথযশা সাংবাদিক দৈনিক জনকণ্ঠের খুলনা ব্যুরো প্রধান শামসুর রহমান হত্যা মামলায় এজাহার ভুক্ত আসামি হওয়ায় প্রার্থী হতে পারেননি। ফলে নাসির উদ্দিন কালুর স্ত্রী শরিফুন্নেছা মিকিকে সভাপতি এবং কালুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নে শাজাহান আলীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। শাহাজান আলী তার মামা কালুর আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে প্রথমে সাফদারপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। পরে সরাসরি তাকে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এরপর কালু দলীয় দায়িত্বে না থাকলেও তার স্ত্রীকে ছায়া সভাপতি করে পেছন থেকে দল পরিচালনা করে আসছিলেন। ২০০৯ সালে নাসির উদ্দিন কালুর মৃত্যুর পর সভাপতি মিকিকে সভাপতি করে রেখে একছত্র দলের নেতৃত্ব নিয়ে নেন সাধারণ সম্পাদক শহাজান আলী।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৮ বছরে উপজেলা কমিটির অনেক নেতার মৃত্যু ঘটেছে। অনেকে অসুস্থ জনিত কারনে দলের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রয়েছেন। এই সুযোগে একক আধিপত্য কায়েম করে আছেন সাধারণ সম্পাদক শাহাজান আলী।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত ১৮ বছরে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে কোন সম্মেলন হয়নি। ভেঙ্গে পড়েছে সাংগঠনিক অবস্থান। অন্যদিকে শাহাজান আলীর ব্যক্তিগত অবস্থান ও জনপ্রয়িতা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে গেছে। তার প্রমান মিলেছে গত পৌর নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে তিনি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে চতুর্থ অবস্থান পান এবং জামানত হারান । শুধু তাই নয় তার মামা সাফদারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নওশের আলী নাসির ও দোড়া ইউনিয়নের সভাপতি শাজাহান আলীর চাচা শ্বশুর কাবিল উদ্দিন বিশ্বাস স্ব-স্ব ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এ বিষয়ে কথা হয় কুশনা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলামের সাথে।

তিনি গনমাধ্যমকর্মীদের জানান, ২০০৪ সালে উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর আর কোন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সেই বিচারে উপজেলা আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্ব কার্যত ব্যার্থ হয়েছে। তিনি মনে করেন নতুন নেতৃত্ব দলের কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করবে। সাফদারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোঃ খালিদ হোসেন জানান, দীর্ঘদিন একক নেতৃত্বের কারনে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঠিক মুল্যায়ন করা হয়নি। এতদিন কোটচাঁদপুর আওয়ামী লীগ অনেকটা একক নেতৃত্বে চলছে। তিনি জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছে সম্মেলনের মাধ্যম্যে নতুন নেতৃত্বের দাবি রাখেন।

বলুহর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের কর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা নরুল ইসলাম চুন্নু আগামীকালের সম্মেলনকে সামনে রেখে বলেন, দীর্ঘদিন একজন ব্যক্তি দায়িত্বে থাকলে তার মধ্যে একছত্র প্রভাব খাটানোর পাশিপাশি একনায়তন্ত্র প্রতিষ্ঠার মানষিকতা সৃষ্টি হয়। যে কারনে দল বা সংগঠনে নির্দিষ্ট মেয়াদের পর নতুন নেতৃত্ব তৈরীর জন্য সম্মেলন বা ভোটের ব্যবস্থা থাকে। তার দাবি উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হোক।

গত ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত কোটচাঁদপুর পৌর আওয়ামী লীগের নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক রিপন মণ্ডল বলেন, দীর্ঘদিন পর সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছি। একই ভাবে তিনি উপজেলা কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচনের পক্ষে মতামত প্রদান করেন। সেই সাথে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নেয় তাদেরকে এই সম্মেলনের মাধ্যমে বয়কট করার দাবী জানান তিনি।

বর্তমান কমিটির সভাপতি ও কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুন্নেছা মিকি জানান, তিনি দীর্ঘদিন এই পদে আছেন। ২০০৪ সালের পর ২০১৭ সালে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এই কমিটির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন।

তিনি আরো বলেন, তিনি গত ১৮ বছর দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে মাঠে আছেন। আগামী ১৯ মার্চ তাকে বা অন্য যে কোন ব্যক্তিকে দলের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি তাদের সাথে এক সাথে কাজ করবেন।

সম্মেলন ও বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কথা হলে কোটচাঁদপুর উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহাজান আলী জানান, ২০০৪ সালের কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালে। এরপর নানান কারনে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। তিনি বলেন, তিনি দলের সকল নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে গত ১৮ বছর কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিটি দলীয় প্রগামে সকল নেতা-কর্মীর উপস্থিতি সেটাই প্রমান করেছে। এ ছাড়া দৃশ্যত তার উপজেলায় কোন গ্রুপিং বা লবিং নেই বলে তিনি দাবি করেন।

অন্যদিকে পৌর নির্বাচনে তার পরাজয় একটি মহলের ষড়যন্ত্রের অংশ বলেও তিনি দাবি করেন। এছাড়া গত ইউপি নির্বাচনে তার দুজন নিকট আত্মীয়ের পরাজয়ও সেই ষড়যন্ত্রে অংশ বলে তিনি জোর দাবি করেন। আগামীকালের সম্মেলনে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যে পন্থায় হোক যাদের নেতা নির্বাচন করবেন, তিনি সেটাই মেনে নিবেন বলে জানান।

(একে/এসপি/মার্চ ১৮, ২০২২)