মোহাম্মদ ইলিয়াছ


যে সব সামাজিক সমস্যা মানবসভ্যতাকে আজও কলঙ্কিত করে,সাম্প্রদায়িকতা তার অন্যতম।মানুষের মধ্যে ভাষা, জাতি, ধর্ম প্রভৃতির ভিত্তিতে ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভিন্নতার ভিত্তিতে কখনোই একে অপরের শত্রু হয়ে উঠতে পারেনা। অথচ বাস্তবে সেরকমই ঘটতে সচারাচর দেখা যায়। যা একটি হীনমন্যতার পরিচয়। এক সম্প্রদায়ের কাছে অন্য সম্প্রদায়ের লোক হয়ে ওঠে বিদ্বেষ ও ঘৃণার পাত্র। একের প্রতি অপরের অবিশ্বাস, অবজ্ঞা আর অসহিষ্ণুতায় বিষিয়ে ওঠে শ্রুতিমধুর পারস্পরিক সম্পর্ক। সাম্প্রদায়িক কলহ ও সংঘর্ষে তাল মাতাল হয়ে ওঠে তিল তিল করে গড়ে তোলা সমাজ তথা মানব সভ্যতা।

বিভিন্ন কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা এক ভয়ংকর সমস্যারূপে দেখা দিয়েছে। কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে, কোথাও ভাষার ভিত্তিতে, কোথাও জাতি বা আঞ্চলিকতার পরিচয় কে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়গত বৈরীভাব প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াল থাবার প্রকাশ প্রায়শই ঘনিয়ে তুলেছে এক অশনি সংকেত।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুন্ন হওয়ার নেপথ্যে আছে বিভিন্ন কারণ। সাধারণতঃ অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি হিংসা -বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা থেকে মূলত এর উৎপত্তি। অন্যের থেকে নিজেকে অধিকতর শ্রেষ্ঠ মনে করা থেকে অসিহষ্ণুতার জন্ম।কোনো বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়, জাতি বা ভাষা -গোষ্ঠী আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে অপরকে নিকৃষ্ট মনে করে, অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়, তখনই দেখা দেয় পারস্পরিক মতবিরোধ। এই সংকীর্ণ মানসিকতাকে উসকে ধর্মান্ধতা য় আবদ্ধ কিছু অপরিশীলিত ধর্মবোধহীন কিছু শিক্ষিত মানুষ যারা নিজের ধর্ম সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে; আবার কেউ আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্বির পথ পরিস্কার করে। ইংরেজেরা এক সময় আমাদের দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। মূলত তারা হিন্দু -মুসলমানের তথা আঞ্চলিক বিরোধকে তাদের শাসনের মূল হাতিয়ার মনে করতো।স্বাধীনতার পরে ইংরেজরা নেই, তবে শিক্ষিত মৌলবাদী আর কিছু ধর্মান্ধ রাজনৈতিক নেতারাও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।

সাম্প্রদায়িকতার পরিনাম যে কত ভয়াবহ হত পারে, ইতিহাসে বারবার তার প্রমাণ মিলেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, হিটলারের ইহুদীবিদ্বেষ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কথা। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ পরিণতির দৃষ্টান্ত প্রচুর। স্বাধীনতার আগে এবং পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু -মুসলমানের দাঙ্গায় কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এসবের মধ্যে দিয়ে ঘটেছে বহু রক্তপাত, বিপন্ন হয়ে উঠেছে জাতীয় সংহতি।

আমরা যদি সংঘবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই তাহলে খুব শীঘ্রই দেশের মাটি থেকে এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব।

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আজ অভাবনীয় উন্নতি করেছে। শিল্প,সাহিত্য, সংগীত, দর্শন প্রভৃতিতে মানুষের সমৃদ্ধি ঘটেছে ব্যাপক।অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ আজও আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারিনি। এখনো আশেপাশের অনেক প্রিয়জনদের ভদ্র আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে ভয়ালদর্শন ও কালোমেঘে আবৃত রুদ্র মূর্তি। যা আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। তাই এখনই সময় নিবিষ্ট না করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। উদ্ধার করতে হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া লাল-সবুজে আবৃত সোনার বাংলা কে।

লেখক : ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)।