কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : কুষ্টিয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সে চলছে দেড় শতাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

ক্লিনিক মালিকদের অভিযোগ, লাইসেন্স নবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টরা যথাসময়ে আবেদন করলেও পরিদর্শন করে সেগুলো নবায়নের ব্যবস্থা করছে না সিভিল সার্জন অফিস।

অন্যদিকে, জেলা প্রশাসনের অভিযোগ, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অসহযোগিতার কারণে প্রশাসন অভিযোগ প্রাপ্তির পরও সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।

তবে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কুষ্টিয়াতে ১৫০টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে। এগুলো পরিদর্শন, দেখভাল এবং পরিচালনায় কিছু কিছু সময় সমস্যা হলেও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় সেভাবে অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়নি। আবার অনেক সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গেলে ক্লিনিকে সাংবাদিকের আত্মীয়, বা রাজনীতিবিদ অথবা প্রভাবশালীর অনুরোধে সঠিকভাবে অভিযান চালানো হয়ে ওঠেনা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গত ৫ বছরে গড়ে উঠেছে অন্তত ১৫০টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চিকিৎসার নামে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

সরকারি নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও লাইসেন্স ছাড়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, অনেকে শুধু জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছেন। মনিটরিং না থাকায় অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনেকে এই ব্যবসায় নেমে পড়ছেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর, ভেড়ামারা, খোকসা, কুমারখালী ও দৌলতপুরের কয়েকটি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের যৌথ অভিযান চালায়। অভিযানকালে কুমারখালীর কয়েকটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বেহাল অবস্থার বিষয়টি নজরে আসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের।

এ সময় জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশেপাশে অবস্থিত কিছু ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দেন সিভিল সার্জন ও উপজেলা প্রশাসনকে।

কুষ্টিয়া জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান এবং কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেলা আক্তার অভিযান পরিচালনা করে কয়েকটি ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এবং কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক যন্ত্রপাতি এবং সুবিধাদি না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়।

এছাড়া এসব ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিককে ভবিষ্যতে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে আরো কঠিন সাজা দেয়া হবে মর্মে সতর্ক করেন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে গড়ে ওঠা একতা ডায়গনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিক থেকে ডা. এস এ শেখ নামে এক ভুয়া চিকিৎসকের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসককে দুই দিনের মধ্যে কুষ্টিয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ও তিনি তার চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই ক্লিনিকে গ্রাম থেকে কোয়াক ডাক্তাররা বেশি বেশি করে রোগী আনলে সেসব ডাক্তারদের ৩ তলার উপরে বিশ্রাম নেয়ার জন্য পাঠানো হয় বলে একটি বিশেষ সূত্রে জানা গেছে।

উপরের রুমে গ্রাম থেকে আসা কোয়াক ডাক্তারদের মনোরঞ্জন করার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। তবে শুধু এই ক্লিনিকই নয় আরো বেশ কিছু ক্লিনিক রয়েছে যারা কমিশনের ভিত্তিতে ছাড়া কোয়াক ওইসব চিকিৎসকদের খুশি রাখতেই ক্লিনিক মালিকরা এ ব্যবস্থা করেছেন।

এমন অভিযোগ খোকসার মেরি ইন্টারন্যাশনাল মিশন হাসপাতাল নামে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের বিরুদ্ধেও। সেখানে বাইরে থেকে যতোটা না চাকচিক্য ভেতরের পরিবেশ তার ঠিক উল্টো। তবে এলাকাবাসী জানান, আব্দুল মতিন নামে ওই লোক নিজে ইসলাম ধর্ম পরিবর্তন করে মাইকেল নাম ধারণ করেছেন। চিকিৎসা সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান না থাকলেও তিনি হয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক। সেখানে ডিপ্লোমাধারী কোনো নার্স না থাকলেও রয়েছে নার্সের মতো সুন্দরী তরুণীরা। কিছুদিন আগে এই ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হওয়ায় তারা তড়িঘড়ি করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পরে টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয় কর্তৃপক্ষ।

শুধু এরা নয় শহর ছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে বেশ কিছু ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক রয়েছে এই তালিকায়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জেলার ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স না নিয়েই পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ৫ বছর থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
শহরের সার্কিট হাউজের সামনে অবস্থিত সততা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক আবার সোমা ক্লিনিক নামে চালানো হচ্ছে। সেখানে তারা রিকশা চালক ও ইজিবাইক চালকদের কমিশনের ভিত্তিতে রোগী হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, কাগজে কলমে পদ্মা কমিউনিটি হাসপাতাল থাকলেও পদ্মা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড প্রাইভেট হাসপাতাল নামে সাইনবোর্ড টানানো রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে আসলেও লাইসেন্স নেই বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান।

এছাড়াও এ ক্লিনিকে এক রোগীকে ভর্তি করে তার অবিভাবকরা। এরপর সন্তান জন্ম দেয়ার পর সেই সন্তানকে টাকার বিনিময়ে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলে বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। পরে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ক্লিনিক মালিকসহ ৩ জনকে আটক করে।

শহরের পদ্মা কমিউনিটি হাসপাতাল, ইসলামীয়া হাসপাতাল, কুষ্টিয়া নার্সিং হোম, হরিণারায়ণপুরের সেবা প্রাইভেট হাসপাতাল, নিউসেবা প্রাইভেট হাসপাতাল, ঝাউদিয়া ক্লিনিক, পোড়াদহের নাহার ক্লিনিক, দৌলতপুর উপজেলার দৌলতপুর ক্লিনিক, আলহাজ ক্লিনিক, মডার্ণ ক্লিনিক, সুপার সনো, কোহিনুর নার্সিং হোম, তারাগুনিয়া ক্লিনিক, জননী নার্সিং হোমসমূহ ২০১১ সালের পর থেকে আর কারো লাইসেন্স নবায়ন করেনি।

কুমারখালী উপজেলার কুলসীবাসা এলাকার ফাতেমা ক্লিনিক, দৌলতপুরের হোসেনাবাদ ক্লিনিক, আরোগ্য সদন, আল্লারদান ক্লিনিক, মায়ের দোয়া ক্লিনিক, সিটি প্রাইভেট হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে চললেও সিভিল সার্জন অফিসের তালিকায় নাম নেই।

সিভিল সার্জন অফিসের রেজিস্ট্রেশন তালিকায় থাকলেও প্রায় ৪ বছর ধরে নবায়ন করেনি বেশ কিছু ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে কুতুব উদ্দিন মেমোরিয়াল হাসপাতাল, শামসুজ্জামান মেমোরিয়াল হাসপাতাল, মরিয়ম ক্লিনিক, পদ্মা কমিউিনিটি হাসপাতাল, ইসলামীয়া হাসপাতাল, মেডিকেয়ার হাসপাতালসহ জেলার বাইরে বিভিন্ন উপজেলা সদরের প্রায় ২৫টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।

এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসার আড়ালে প্রতারণার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভুক্তভোগীরা জানান, প্যাথলজি বিভাগে যন্ত্রপাতির অভাব, প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের স্বল্পতা ও ভুল রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা করা হয়। অনেক চিকিৎসক ছুটি ছাড়াই কর্মস্থল ছেড়ে এসব প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখেন।
সূত্রমতে, গত তিন মাসে জেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে ১১টি ক্লিনিক সিলগালা ও প্রায় ১৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায়, ৪ জনকে আটক ও ২ চিকিৎসককে সতর্ক করেছে। তবে সেগুলো আবারো চালুও হয়েছে।

এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চিকিৎসক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে নামীদামী চিকিৎসকদের নামের সিল-প্যাড ব্যবহার করে পরীক্ষার রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়াও একই ডাক্তার শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে সাইনবোর্ড দেয়া রয়েছে যারা সেসব ক্লিনিক বা হাসপাতালে বসেন না। এছাড়াও একই চিকিৎসকের নাম বিভিন্ন ক্লিনিকে সাইনবোর্ডে টানানো থাকে। ফলে রোগীরা ঠিকভাবে বুঝতে পারেনা কোনো চিকিৎসক কোথায় বসেন।
সরকারি নীতিমালায় একটি ১০ শয্যার ক্লিনিক পরিচালনায় ৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার, ৬ জন ডিপ্লোমা নার্স, ৬ জন আয়া এবং ৩ জন সুইপার নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু ক্লিনিক পরিচালনায় সরকারি নীতিমালা অনেক মালিক বিভিন্ন অজুহাতে মানতে চান না। এসব ভুয়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের সেন্টারের বিরুদ্ধে অতিসত্ত্বর সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

(ওএস/এটিআর/সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৪)