শিতাংশু গুহ


হৃদয় বণিক বিজ্ঞানের শিক্ষক। দশম শ্রেণীতে ক্লাশে শিক্ষার্থীরা দাবি করে যে, বিজ্ঞানের উৎপত্তি কোরান থাকে এবং নবী মুহাম্মদ শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী। শিক্ষক বললেন, ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান দু’টি আলাদা বিষয়। ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়নি। বিজ্ঞান প্রমাণিত সত্য, আর ধর্ম হলো বিশ্বাস। বর্তমানে বিশ্বে বিজ্ঞানীদের নব্বই শতাংশ ইহুদি ও খৃষ্টান, তাঁরা কোরান পড়েনা’।

শিক্ষার্থীদের মনে হলো স্যার হয়তো ‘ইসলাম ও নবীর’ অবমাননা করেছেন। তাঁরা প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলেন। হেডস্যার বিজ্ঞানের শিক্ষককে তিনদিনের জন্যে সাসপেন্ডের কথা বললেন, ছাত্ররা অখুশি হয়ে মিছিল বের করলো, বাইরের মানুষ তাতে যোগ দিতে বেশি সময় লাগলো না। শ্লোগান উঠলো, ‘হৃদয় বণিকের ফাঁসি চাই; মালাউনের ফাঁসি চাই’।

ঘটনা মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকানাই উচ্চ বিদ্যালয়ের, সময়টা মার্চ ২০২২। এরপর পরই সামাজিক মাধ্যমে একজন অপর্ণা চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘স্কুলের চাকুরীটা ছেড়ে দিলাম। আমি বিজ্ঞান পড়াই। মানুষের উদ্ভব এককোষী থেকে কেন হবে? কোরানে তা লেখা নাই, আপনি ভুল জানেন ম্যাডাম। আমি চেষ্টা করেছি, ভয় পেয়েছি, অবমাননার দায়ে ফাঁসিয়ে দেবে’?

জান্নাতুল ফেরদৌস কলি লিখেছেন, আমি কখনোই ধর্মীয় বিষয় বলতে চাইনা, বায়োলোজি পড়াই, কন্ট্রাডিকশন হয়েই যায়। চেষ্টা করি সমভাবে এগুতে, কি আছে আল্লাহই জানেন। চাকুরীটা থাকে কিনা, তবে এখন থেকে আরো সতর্ক হবো। বইয়ের বাইরে কোন তথ্য দেয়া যাবেনা। আগে নিজে বেঁচে পরে ছাত্র। শিক্ষার্থীদের বিদ্যা দেয়ার আর ওদের বিদ্যা নেয়ার দিন শেষ–এখন শুধু চাকুরী বাঁচানো’।

ভাবছিলাম, আমরা যখন দশম শ্রেণীতে পড়তাম, তখন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তো দূরের কথা, হেডস্যার বা বাড়ীতে এসে নালিশ করলেও উল্টা ফল হতো। আর এখন ছাত্ররা ওঁৎ পেতে থাকে শিক্ষককে ধরার জন্যে? হৃদয় বণিকের বক্তব্য নাকি টেলিফোনে হয়েছে। কলেজে ডারউইনের মতবাদ পড়াতে গিয়ে টিচার ধর্মের গুনগান করেননি, তাতে ছাত্ররা নাস্তিক হয়ে গেছে বা ধর্ম খত্রাতে পড়েছে?

ইসলাম রক্ষার নামে একাত্তরে যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই রাজাকার হয়েছেন। ইসলাম খত্রামে হ্যায়, ধর্মের বা নবীর অবমাননা -এ জাতীয় বিষয়গুলোর সাথে ধর্মের সম্পর্ক নেই, রাজনীতির সাথে থাকতে পারে। ধর্মে যখন রাজনীতি ঢুকে বা রাজনীতিতে ধর্ম, তখন এসব ঘটে। আর রাষ্ট্র যখন এর পৃষ্টপোষকতা করে দেশ তখন গোল্লায় যায়।

ঢাকার ইনকিলাব (৩০শে মার্চ ২০২২) পত্রিকার ‘ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানে শিক্ষিকাকে গলা কেটে হত্যা’। ব্লাসফেমির অভিযোগে দুই ছাত্রী শিক্ষিকার গলা কাটে। এখানে নিহত বা হত্যাকারী একই ধর্মের। সেই অর্থে হৃদয় বণিকের কপাল ভালো। হৃদয় বণিকের মত আর একজন শিক্ষক লিখেছেন, ‘আমি হিন্দু, শিক্ষক। শিক্ষকতা করতে ভয় হচ্ছে, কখন যে ফাঁসিয়ে দেয়’।

এই ‘ফাঁসিয়ে দেয়া’-টা-ই মুখ্য। এখানে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। ধর্ম জিনিষটা এতটা ঠুন্কো নয় যে কেউ কিছু লিখলে, বা বললে সেটি অবমাননা হয় বা বিপদগ্রস্থ হয়? ধর্ম নিয়ে দেশে যতটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে, তাতে বোধহয় দেশে বিজ্ঞান চর্চার কোন প্রয়োজন নেই। এটি অধ:পতন এবং তখনই বেশি হচ্ছে, যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রগতিশীল সরকার ক্ষমতাসীন।

নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল ভক্তের কথা মানুষ ভুলে যায়নি। শ্যামল ভক্ত থেকে হৃদয় বণিক বা আরো কত শিক্ষক বা মানুষ ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগে লাঞ্ছিত হচ্ছেন সেই হিসাব কে রাখে? যেদেশে ধর্মীয় অনুভূতির নামে বারবার শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছেন, সেদেশে শিক্ষিত জাতি আশা করা বোকামী। গোল্লায় যাক শিক্ষা, জাতি মূর্খ থাকুক। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিগুলো মাদ্রাসায় পরিণত করা হোক।

দেশে হিন্দু শিক্ষকরা আতঙ্কে আছেন। নাকি দেশজুড়ে হিন্দুরা আতঙ্কে আছেন? শুধু কি হিন্দুরা, নাকি পুরো জাতি আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন? বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামী মৌলবাদী শক্তির ভয়ে পুরো দেশ, সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল সবাই আতঙ্কগ্রস্থ। সবাই আপোষ করছেন। মুখে বলছেন, ‘দেশের মানুষ মৌলবাদী নন, ধর্মভীরু’ -এ কথা বলে মৌলবাদকে প্রশ্রয় এবং নিজেকে সান্তনা দিচ্ছেন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।