আবীর আহাদ


জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার স্বার্থে আসলেই আর চুপ থাকা সম্ভব নয়। সততা ও বিবেককে জাগ্রত করতে হবে আর এর প্রতিকারও বিধান করতে হবে, কারণ কী দুর্ভাগ্য আমাদের যে জাতীয় চার নেতার নাম জানে না একজন শিক্ষার্থীও! জানে না মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম কি, এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষার্থীরা বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও এম এ জি ওসমানীর নাম!

গত শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বিজয়ের ৫০ বছর : পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ-বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে উপস্থাপন করা গবেষণাপত্রে এসব ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

জাতীয় চার নেতার নাম বলো এর জবাবে শতভাগ শিক্ষার্থী ভুল উত্তর দিয়েছে। পৃথক উত্তরে তারা বলে, বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও এইচ এম এরশাদ জাতীয় চার নেতা! ৩ নভেম্বর সম্পর্কেও শতভাগ শিক্ষার্থী ভুল উত্তর দিয়েছে। ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তরে বলে, মুক্তিবাহিনী, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল!

স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারের মধ্যে পার্থক্য কী—এমন প্রশ্নেও শতভাগ শিক্ষার্থী ভুল উত্তর দিয়েছে। ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তর দেয়, খন্দকার মোশতাক ছিলেন প্রথম শহীদ, সেক্টর কমান্ডার, কবি ও ভাষাসৈনিক। একজন সেক্টর কমান্ডারের নাম জানতে চাইলে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী নাম বলতে পারেনি!

এসব অসংগতি ও বিভ্রান্তি ঘটেছে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে। এখানে বিশেষ করে আজ প্রায় ১৪টি বছর আওয়ামী লীগ সরকার একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকলেও তারা নূরুল ইসলাম নাহিদ ও দীপুমণির মতো অপদার্থ লোকদের শিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা এতোটি বছর মন্ত্রীগিরি করলেও শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্নিবেসিত করতে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয়্ দিয়েছে। তারা ছিলেন ও আছেন চাটাচাটি আর নেতৃত্বের বন্দনায় বিভোর। মাঝখান দিয়ে কোমলমতী ও শিক্ষার্থীরা হয়েছে ইতিহাসবিমুখ। অর্থের বিনিময়ে প্রশাসনে ঢুকে পড়েছে রাজাকার আলবদরদের বাচ্চাসহ শিবির ছাত্রদল হেফাজতী শাবকরা। প্রশাসনের সর্বস্তরে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মান্ধরা জেঁকে বসেছে।

এ অবস্থায় সোহেল তাজ যে ৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন তা অবশ্যই মূল্যায়ন পাওয়ার অধিকার রাখে।তাঁর দাবি নিম্নরূপ:

১. যেহেতু ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় সেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র (প্রজাতন্ত্র) হিসেবে জন্ম লাভ করে এই দিনে, তাই এই দিনটিকে "প্রজাতন্ত্র দিবস" ঘোষণা করতে হবে।

২. ৩রা নভেম্বর' জেল হত্যা দিবসকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে।

৩. জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল বেসামরিক ও সামরিক সংগঠক, পরিচালক, অমর শহিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম , অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ও সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

তবে সোহেল তাজের ২ নং দাবি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হলেও বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন চিন্তার সুযোগ রয়েছে। কারণ একটি দেশে দু'টি শোক দিবস হয় না। আমাদের দেশে বহুকাল পূর্ব থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষিতে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিশেবেই পালিত হয়ে আসছে। ৩রা নভেম্বরের জাতীয় চার নেতার হত্যা দিবসকে একই শোকদিবস ঘোষণা করা হলে ঐতিহাসিক আরেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। সে বিবেচনায় জাতীয় চার নেতার হত্যার দিনটিকে "জাতীয় বিষাদ দিবস" বা এধরনের অন্যকোনো নামে ঘোষণার করার দাবি জানানো যেতে পারে।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।