রিপন মারমা, রাঙামাটি : ফেলে আসা বছরে অশান্তির রক্ত ঝরেছে পাহাড়ে সেই রক্ত মুছে নিয়ে রক্তজবা, মধু মালতী, বিজু আর নয়নতারা ভেসে গেল কাপ্তাই হ্রদের আর কর্ণফুলী নদী জলে ভেসে গেল নতুন ভোরের সূর্যকে স্বাগত জানাতে আজ নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পাহাড়ে এখন চাকমাদের বিজুর গান। এ উৎসবের প্রথম অংশ শুরু হয় নদীতে ফুল ভাসিয়ে। চাকমা রীতিতে এই ফুল ভাসানের নাম ‘ফুল বিজু’। আর ত্রিপুরারা বলে ‘হারি বৈসুক’ মারমা বলে পাইনছোঁয়াং তবে মারমাদের পাইনছোঁয়াং হবে ইংরেজি ১৩ (এপ্রিল)। 

দেশের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির ১৪টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ এখন বর্ষবরণ ও বিদায়ের এই উৎসবে মাতোয়ারা। পাহাড়িদের জীবনে এটাই বছরের প্রধান সামাজিক উৎসব।

তাদের বিশ্বাস, দেবতার উদ্দেশ্যে ফুল ভাসালে পুরানো বছরের গ্লানি থেকে মুক্তি মেলে। তাই চাকমারা মঙ্গলবার ভোরের আকাশে রক্তিম সূর্যের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রাঙামাটির চাকমা ও ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীরা ফুলের ডালা হাতে দলে দলে হাজির হলেন কাপ্তাই হ্রদের।

এদিন সবজি দিয়ে রান্না করা পাঁচন, পিঠা আর নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন থাকে মারমা পরিবারে। নতুন পোশাক পরে, পাড়া বেড়িয়ে, নেচে গেয়ে চলে আনন্দ উৎসব। বয়স্করা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যান। তরুণরা অংশ নেয় ‘ঘিলাখেলা’ নামে জনপ্রিয় একটি খেলায়।

চাকমারা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুলবিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূলবিজু’ এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘গজ্যাপজ্যা’ বিজু পালন করা হয়।


চৈত্র মাসের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনকে ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে। আর নববর্ষের প্রথম দিনটি হল ‘বিসিকাতাল’।

এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাঙামাটি শহরের গর্জনতলী এলাকায় কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসান ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা। পরে জ্বালানো হয় মঙ্গল প্রদীপ।

উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ও চাকমা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তুলে ঘর সাজায়। ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। এ দিন গৃহপালিত সব প্রাণিকে খুব ভোরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে ছেলেমেয়েরা গ্রামে ঘুরে বেড়ায় খাবারের আয়োজনে থাকে হরেক রকম পিঠা।

ফুলবিজুর দিনে চাকমারা বিজুর ফুল তুলে তা দিয়ে ঘর সাজায়। পরে সে ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

ফুল ভাসানোর পর্ব শেষে তরুণ-তরুণীরা ঘরে ফিরে বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়।পাড়ার বয়স্কদের শরীরে পানি ঢেলে তাদের আশীর্বাদ কামনা করে। তাদের জন্য দেওয়া হয় নতুন পোশাক।

বিজুর ফুল উৎসবে কথা হয় নয়ননিতা চাকমার সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন,। গঙ্গা মাকে স্মরণ করে পানিতে ফুল ভাসিয়ে এসেছেন তিনি।

তিথি বলেন, “ফুল বিজু আমাদের আদি থেকে চলছে আসছে। আমরা এ ফুল বিজুর মধ্য দিয়ে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করছি।”

আর জিশিকা চাকমা বললেন, “পুরোনো বছরের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলার জন্যই আমাদের এ ফুল ভাসানো। আমরা দীর্ঘকাল ধরে ফুল ভাসিয়ে আসছি। আর ফুল বিজুর মধ্য দিয়েই আমাদের মূল বিজু উৎসবের শুরু হয়।”

বিজুর সময় বাড়িতে বাড়িতে হরেক রকম সবজি দিয়ে তৈরি হয় ‘পাঁজন’। আরও থাকে পায়েস, পিঠা, খই, নাড়ু, সেমাই।

চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে যোগ দেয় শোভাযাত্রায়; শিশু-কিশোর ও তরুণ তরুণীরা মেতে ওঠে খেলাধুলায়।

সন্ধ্যায় বাড়ির উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা এবং মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে প্রার্থনা করা হয়।
আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ফুল বিজু।

(আরএম/এএস/এপ্রিল ১২, ২০২২)