শিতাংশু গুহ


৭০’-দশকে জগন্নাথ হল উত্তর বাড়ীতে যাঁরা থাকতেন, তাদের সকালে ঘুম ভাঙ্গতো হরেন-র ডাকে, ‘কিছু লাইগবো নি, বাবু’? হরেন, রাখাল, সুধীরবাবু বা পরে জিতেন’র কথা তো ভুলবার নয়। যেমনি কেউ ভুলবে না, ‘হলের ডাইল’-র গল্প। হয়তো এই ডালের জন্যে জীবনে যত ‘ফ্লাজিল’ খেয়েছি, হল থেকে বের হবার পর আর কখনো খেয়েছি বলে মনে পড়েনা! হলের কথা উঠলেই পয়সা না দিয়ে খাওয়ার প্রসঙ্গ আসে. যাঁরা একদা পয়সা না দিয়ে খেতেন জীবনের কোন পর্যায়ে নামীদামী হয়ে তাঁরা অনেকেই সুধীরবাবু বা জিতেন’র কথা ভুলে যাননি। এতকাল পরে মনে হয়, খেয়ে পয়সা না দেয়াটা যে ঠিক পয়সার জন্যে, তা হয়তো নয়, বরং এরমধ্যে একটা ‘নেতা-নেতা’ ভাব ছিলো, নেতারা খেয়ে পয়সা দেবে সেটা কি হয়? 

ছাত্রজীবনে আমি কখনো টিউশনি করিনি। জগন্নাথ হলে তো নয়ই। ছুটিতে চাঁদপুর গেলে দু ‘একটি সোমত্ত মেয়েকে যে পড়াতাম না, তা নয়! সেটা টিউশনি নয়, বরং ‘ইটিশ-পিটিশ’-র জন্যে। এখন বুঝি মেয়ের বাবা-মা হয়তো চাইতো, ‘ছেলেটি ভালো’, যদি লাইগ্যা যায়? না, লাগেনি! হলে বাপের টাকায় আমার অবস্থা ভালোই ছিলো। একথা বলার কারণ হচ্ছে, আমার টিউশনি করার প্রয়োজন ছিলোনা। তারপরেও ক্যান্টিনে সবসময় পয়সা দিয়েছি, এমন গ্যারান্টি দিতে পারবো না? সান্তনা এটুকু যে, অন্যরা একদম পয়সা না দিলেও আমি মাঝে-মধ্যে পয়সা দিতাম। ঢাকা গেলে জগন্নাথ হলে যাই, হরেন-রাখাল বা অন্যদের খুঁজে বের করেছি।

জগন্নাথ হল প্রসঙ্গ এলে প্রেম আসবেনা তা কি হয়? জগন্নাথ হল একমাত্র ছাত্রাবাস যেখানে ছাত্রীরা নিরাপদে, নির্ভয়ে, অবাধে চলাফেরা করতে পারতো। সম্ভবত: ১৯৭৪ সালে সূর্যসেন হলের দোতালা থেকে এক ছাত্রীর লাফ দিয়ে সম্ভ্রম বাঁচানোর ঘটনাটি এখনো অনেকের মনে থাকার কথা? উত্তর বাড়ীতে অনেকের মত আমার রুমে একটি মেয়ে প্রায়ই আসতো। এতকাল পরে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, প্রেম করলেও তা সর্বনাশা ছিলোনা। একবার পিকনিকে একটি মেয়ে খুব সেজেগুঁজে আসে। দেখে ভালোই লাগে। পিকনিকের কাজে ব্যস্ত থাকায় ওঁর দিকে তেমন নজর দিতে পারিনি। কয়েকঘন্টা পর নমিতা এসে বলেন, ‘এই যে মশাই মেয়েটি যে আপনার জন্যে সেজেগুঁজে এলো, আপনি তো পাত্তাই দিচ্ছেন না’? আসলে একটি মেয়ে যে আমার জন্যে সেজেগুঁজে আসতে পারে, এটি আমার মাথায়ই ছিলোনা। নমিতা তখন সমীরদা’র প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তিনি প্রেম বুঝলেও আমি বুঝতাম না?

এখন বুঝি আমার মত ‘ধুমধাড়াক্কা’ ছেলের জন্যে ‘প্রেম’ নয়! ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রেম করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। আমাদের জন্যেই হয়তো ‘বিয়ের পর প্রেম’? প্রেম নয়, লেখাটি জগন্নাথ হল নিয়ে। আমার প্রথম কদম ফুল ছিলো চাঁদপুরে। তখনকার সময়ে প্রেম এখনকার মত সর্বগ্রাসী ছিলোনা। তখন চোখে-চোখে চাওয়া, একটু হাত ধরার মধ্যে অপার আনন্দ ছিলো। নরসিংদীর ট্যাগ্রা নির্মল দাস, সুভাষ সাহা বা নির্মল বালা’র জন্যে হয়তো একথা সর্বাংশে প্রযোজ্য ছিলোনা। ঐসময় সেলফোন ছিলোনা বা এমনকি ল্যান্ডফোন দুষ্প্রাপ্য ছিলো, একমাত্র যোগাযোগ চিঠিপত্র। একদিন একটি চিঠি পেলাম, লেখা, ‘তোমাকে অনেক ভীড়ের মাঝে খুঁজে পেয়েছি’---ইত্যাদি। না. আমি ভীড়ের মাঝেই হারিয়ে গেছি। সম্ভবত: আমরা ৭৩/৭৪ সালে ডিপার্টমেন্টে নির্বাচন করি, মুজিববাদী প্যানেল, জাফর, মুশতাক, আমি ও অন্যরা। তখন জাসদের রমরমা, আমাদের ভরাডুবি ঘটে।

পরদিন বিকালে ‘রাখাল’ একটি প্যাকেট এনে দেয়। খুলে দেখি, ‘একগোছা চুরি’। সাথে চিরকুট, ‘চুরি পরে থাকুন’। পাঠিয়েছে রোকেয়া হল থেকে সুরাইয়া ও শিরিন, যাঁকে সংক্ষেপে আমরা ‘শিরি’ ডাকতাম। হলের প্রেম জলের মত সর্বদা প্রবহমান। আমি তখন উত্তরবাড়ীতে ১২২ সিঙ্গেল রুমে থাকতাম। এরআগে ছিলাম সাউথের ২২০-তে। উত্তরবাড়ীতে আমার ঠিক উল্টোদিকে থাকতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র অনুতোষ সাহা। একবার ছুটিতে দেরি করে এসে অনুতোষ দেখে তাঁর রুম বে-দখল। পরে অবশ্য অনুতোষ তাঁর রুম ফেরত পায়। আরো বহুপরে আমেরিকাতে একসময় অনুতোষ ও তাঁর বউ’র কাছে এ গল্প করে ‘মাফ’ চেয়ে নিয়েছি। দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও এখনো আমরা বেশ ঘনিষ্ট। অনুতোষ শিল্পী মানুষ, একটি গান তিনি সবসময় গাইতেন, ‘আমার মনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে......। সেই আসনটি কার জানা হয়নি! রোকেয়া হলে গেটে সুদর্শন অজিতদা’র বোরকাওয়ালী’র সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা আমাদের চোখ এড়ায়নি। তখনতো বোরকা তেমন ছিলই না, তাই সেটি ছিলো ব্যতিক্রমী দৃশ্য! এ রকম বহু ছাত্রের প্রেমকাহিনী ভবিষ্যতে ফাঁস করবো বলে আশা রাখি, গল্পের নাম দেবো ‘জগাদের প্রেম’, কেমন হবে? !

টরোন্টো’র সঞ্জিব গাইতেন, ..’কালো বিড়াল কে পুষে পাড়ায়’....। সুবীর নন্দী তখনো উত্তর বাড়ীর দোতালায় গান প্রাকটিস করতেন, রথীন্দ্রনাথ রায় অল্পস্বল্প প্রতিষ্ঠিত, দুলাল ভৌমিক বেশ জনপ্রিয়। পুরুষ মানুষ যে নাচে, কমলের সাথে পরিচিত না হলে তখনো আমরা জানতাম না? দু:খের বিষয় সুবীর ও কমল নেই? পান্টুদা ক্রিকেট খেলতেন, সম্ভবত: ৭৮-এ একদিন টিভিতে দেখি আমাদের পান্টুদাই হচ্ছেন, ‘পীযুষ বন্দোপাধ্যায়’। এরা সবাই ঐসময়কার জগন্নাথ হলের কৃতি সন্তান। স্বপন সাহা মস্কো যাওয়ার আগের দিন রাতে এসেম্বলির ওপরে মিটিং-এ আমি ছিলাম। মুকুল বোস, দ্বিজু খান ওরফে দ্বিজেন্দ্রনাথ সাহা, আরো অনেকে ছিলো। দ্বিজুও নেই? এসেম্বলী ভেঙ্গে পড়ার পর সেদিন রাতেই হলে গিয়েছিলাম, আমি তখন বাংলারবানীতে। পরদিনও গিয়েছিলাম, অক্টবর স্মৃতি ভুলবার নয়।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’- এ জগন্নাথ হলকে টার্গেট করে ‘হিন্দুহত্যা’ করা হয়েছিলো। কেন জগন্নাথ হল? কারণ ওঁরা হিন্দু। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জগন্নাথ হল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ঢাকা ভার্সিটিতে জিয়াউর রহমানকে যে ছেলেটি ঘুষি মেরেছিলো বা ভুট্টোর গাড়িতে যিনি লিফলেট দিয়েছিলেন তিনিও জগন্নাথ হলের ছাত্র। ওবায়দুল কাদেরসহ অনেক ছাত্র নেতার উত্থান জগন্নাথ হল থেকে। পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মও জগন্নাথ হল থেকেই। জগন্নাথ হল আন্দোলনের সূতিকাগার’ যদিও আমরা অবহেলিত। হিন্দু তথা ধর্মীয় সংখ্যালঘু’র ওপর অর্ধ-শতাব্দী ধরে যে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলছে, এর বিরুদ্ধে জগন্নাথ হল গর্জে উঠুক, নেতৃত্ব আসুক হল থেকে। এ সময়ে হল চত্বরে দু’টি বিশাল ভবন হচ্ছে, এটি ভালো। ষড়যন্ত্র হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে মুখরোচক, সুন্দর সুন্দর কথা বলে, ঐসব ভবনে অন্যদের প্রবেশাধিকার দেয়া না হয়, যাতে ‘জগাবাবু’র ঐতিহ্য সমুন্নত থাকে।

লেখক : সভাপতি, জগন্নাথ হল এলামনাই এসোসিয়েশন, ইউএসএ।