আবীর আহাদ


একদা ইরানের সম্রাট রেজাশাহ পাহলবী, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সিলাসী, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ট মার্কোস, মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক এভাবে বিশ্বের বহু দুর্নীতিবাজ লুটেরা শাসক সেসব দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার/পাউণ্ড  লুটপাট করে সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন এবং পরবর্তীকালে জানা যায় যে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা সেসব অর্থ নাকি আর ফেরত পাননি। অর্থাৎ সুইস ব্যাংক সুযোগ বুঝে সেসব অর্থ বাজেয়াপ্ত করে আত্মসাত করেছে। যেহেতু সেসব ছিলো অনৈতিক পন্থায় লুটকৃত কালো টাকা, তাই তার মালিকরা আইনত: সুইস ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোথাও মামলা করতে পারেননি। অনেক লুটেরা শাসক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর তাদের উত্তরাধিকাররা সে-অর্থ ফেরত পেয়েছে বলেও জানা যায়নি।

বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক দুর্নীতিবাজ লুটেরা প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়স্বজন, মন্ত্রী এমপি সচিব জেনারেল ব্যবসায়ী শিল্পপতি ও মাফিয়ারা সুইস ব্যাংকসহ আমেরিকা বৃটেন পানামা কানাডা দুবাই সিঙ্গাপুর মালায়েশিয়া ও অন্যান্য দেশে অঢেল অর্থ গচ্ছিত রাখছেন। তারা কেউ কেউ সে-অর্থ ভোগ করতে পারছেন এবং আবার অনেকেই নাকি পারছেন না! ঐসব বিদেশের ব্যাঙ্ক জানে যে, যারাই এখানে অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন, তারা তা তাদের দেশ থেকে লুটপাট করে এনেছেন। সেসব দেশে এসব অর্থ আইনের চোখে কালো টাকা। এসব কালো টাকা মেরে দিলে লুটেরাচক্র তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে বা আইনের আশ্রয় নিতে পারবে না। ফলে অর্থগুলো ঐসব দেশের ব্যাংকগুলো মেরে দিয়ে থাকে।

একটা উদাহরণ দেই। আমাদের দেশের তথাকথিত প্রিন্স মুসা বিন শামসিরের পঁচানব্বই হাজার কোটি টাকা নাকি সুইস ব্যাংক বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে বলে তিনি প্রকাশ্যে একাধিকবার স্বীকার করেছেন। এভাবে অনেকের অর্থই সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাঙ্ক আত্মসাত করেছে বলে অনুমিত হয়। মুসা বিন শামসিরই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

এছাড়া সরকারের বিভিন্ন ছোট বড়ো ও মেগা প্রকল্প ও কেনাকাটায় প্রকৃত ব্যয়ের চাইতে শত শত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজার গুণ বাড়তি মূল্য দেখিয়ে তা আত্মসাত করা হলেও এর সাথে জড়িত আমলা, ব্যবসায়ী ও এমপি-মন্ত্রীদের কোনোই জবাব দিতে হয় না! এছাড়া একটা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নামধারী দুর্বৃত্ত ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে শতশত হাজার হাজার কোটি আত্মসাত করে থাকে। এই ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তরা শেয়ারবাজার পরিচালনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেও শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে। ওপর মহলে কমিশন প্রদান করে তারা ক্ষমতাশালীদের আনুকূল্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। এসব উচ্চপদস্থ আমলা, ব্যবসায়ী ও লুটেরা রাজনীতিকরা আত্মসাতকৃত অর্থ দিয়ে দেশে-বিদেশে অতি রাজকীয় জীবন যাপন করে থাকেন। তাদের অনেকেই আমেরিকা কানাডা ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া দুবাই সিঙ্গাপুর মালয়েশীয়া প্রভৃতি দেশে "সেকেণ্ডহোম" নামীয় প্রাসাদোপম বাড়িতে বৌ-ছেলে-মেয়ে রেখে দেন, নিজেরাও মাঝেমধ্যে সেখানে অবস্থান করেন। তারপরেও নিজেরা এদেশে থেকে আরো লুটপাটে জড়িত থেকে লুটকৃত অর্থ সেসবখানে পাচার করে থাকেন।

আমার জানা মতে, ব্যক্তিখাতের বহুমুখী একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এদেশের বিদ্যুত্, জ্বালানি, আইটি, শিপিং, সিমেন্টসহ বড়ো বড়ো বাণিজ্য ও শিল্পের সাথে জড়িত থেকে বিশাল লুটপাটীয় আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। তাদের হেডকোয়ার্টার সিঙ্গাপুরে। মূলত: বাণিজ্যের অজুহাতে বাংলাদেশ থেকে লুটপাট করে নিরাপদে থাকার জন্যেই এ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অধিকাংশই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেন। শোনা যায়, সিঙ্গাপুরে তারা এক নম্বর ধনিকের খাতায় নাম তুলেছেন! এ জাতীয় আরো কতিপয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এদেশ থেকে লুটপাট করে বিদেশে বিশাল ধনিক হিশেবে পরিগণিত হচ্ছেন। বিদেশে অর্থ পাচারকারী এধরনের হাতেগণা ৬০/৭০টা বিশাল লুটেরা পরিবারের সাথে জড়িত আমলা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, রাজনীতিক, এমপি, মন্ত্রীদের একটা তালিকা কিছুদিন আগে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছিলো। এটা নিয়ে কিছু হইচই পড়ে গেলেও সরকার বা দুদক কোনোই রা করেনি। এতেই বুঝা যায়, ডালমে কুচ কালা হ্যায়! তবে এটাও জানা গেছে যে, এসব বিশাল অর্থ পাচারকারী দুর্বৃত্তরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের মানুষ! আর কী আশ্চর্য, তাদের অনেকেই জামুকার আনুকূল্যে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' খাতায় নামও লিপিবদ্ধ করেছেন! এতেই বুঝা যায়, কারা ছলেবলেকলেকৌশলে এদেশটাকে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছেন। কারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ভুলুন্ঠিত করে চলেছেন।

সুতরাং আমাদের দেশ থেকে যেসব শাসক দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্র লুটপাট করে বিদেশী ব্যাঙ্কে অর্থ গচ্ছিত রেখেও সেসব ব্যাঙ্কের হাতে মার খেয়েছেন ও খাচ্ছেন, তা জেনেশুনে কেনো যে তারা লুটকৃত অর্থ সেসব ব্যাঙ্কেই রাখেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দশ/বারো লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে!

আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরাচক্র অর্থ লুটপাট ও তা পাচারের মধ্যে একধরনের মাদকীয় নেশা উপভোগ করে থাকে অর্থাৎ তারা মানসিক বিকারগ্রস্ত; বিকৃত রূচির মানসিক রোগী। এরা বাংলাদেশের শত্রু, দেশদ্রোহী।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।