মুক্তিযোদ্ধারা নন, এমপি মন্ত্রী আমলা ব্যবসায়ীরাই মুক্তিযোদ্ধাদের উপকারভোগী
আবীর আহাদ
বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের নির্মাতা। দাতা। তাঁরা দেশটি স্বাধীন করে এ জাতিকে বিশ্বসভায় পরিচিত করেছেন। তাদের মাধ্যমেই দেশটি একটি পতাকা, একটা জাতীয় সঙ্গীত, একটা জাতিত্ব পেয়েছে। তাঁরা তাদের জীবনপণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনা করেননি তিনি তাই হতে পারছেন। তাদেরই প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে বাঙালিরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, জেনারেল, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী প্রভৃতি হচ্ছেন। অথচ এই বীর মুক্তিযোদ্ধারাই সবার জন্য, সবার ভাগ্য নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করে, সবাইকে উপকার করে, বিনিময়ে কিছু না নিয়েই দেশকে উপহার দিয়ে যে যার অঙ্গনে ফিরে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই উপকার বরং ভোগ করে আসছেন জীবনে যারা যা কল্পনা করেননি, তারা, যা আগেই বলেছি। তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের কৃত উপকার গলাধঃকরণ করছেন। অথচ তাদেরই অর্জিত দেশের সরকারের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আমলা-কামলা-মন্ত্রী উল্টো বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই দেশের 'উপকারভোগী'র অপবাদ দিয়ে সমাজের কাছে হেয় করছেন, অসম্মান করছেন!
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কিছু প্রজ্ঞাপনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপকারভোগী বলে উল্লেখ করার প্রেক্ষিতে আমাকে উপরোক্ত কিছু অপ্রিয় কথা বলতে হলো। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, বীর মুক্তিযোদ্ধারা নন, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ফসল ভোগ করছেন অনেকেই যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি; দেখেননি। যিনি বা যারা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগে সৃষ্ট দেশের জলবায়ু, চাকরি-বাকরিসহ অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করছেন, তারা অকৃতজ্ঞের মতো সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী গ্রহণ করাকে 'উপকারভোগী' বলে উপহাস করে তাদেরকে ক্ষমাহীন অপমান করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী হিশেবে প্রকাশ করেছেন। যেসব আমলা-কামলা, এমপি-মন্ত্রী, দুর্নীতিবাজ-লুটেরাচক্র মুক্তিযোদ্ধাদের করুণায় সৃষ্ট বাংলাদেশের বিভিন্ন আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আসছেন, অথচ সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা ও সৌজন্যবোধ প্রকাশ করেন না, এমপি-মন্ত্রীগিরি, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য কেনো, তাদের তো বাংলাদেশেই থাকার অধিকার নেই। তারাই বরং এদেশে পরজীবী; পরের ধন লুণ্ঠনকারী!
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসৌজন্যতা প্রকাশকারীদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলতে হয়, উপকারকারীদের উপকারের ফসল ভোগ করবেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা গ্রহণকারীদের 'উপকারভোগী' বলে অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখবেন, এটা চরম ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির গর্বিত সন্তান। তাদের ঐতিহাসিক শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে সৃষ্ট স্বাধীন দেশের রূপকার হিশেবে গণ্য করে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মাসিক সম্মানী ভাতা দিয়ে তাদের করুণা করছেন না। এটা তাদের অধিকার। তাদের বেঁচে থাকার অধিকারকে একটু স্বীকৃতি দিয়ে সরকার তাদের সম্মানিত করছেন। জাতির কিছুটা দায় পরিশোধ করছেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উপকারভোগী হিশেবে গণ্য করে সরকারের দুর্নীতিবাজ ও অকৃতজ্ঞ কামলা-কেরানিরা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাগ্রহণকারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার ঘৃণ্য মানসিকতা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উপকারভোগী বলে চিত্রিত করে তাদেরকে অসম্মান করেছেন! এটা মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা গ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে 'উপকারভোগী' নামক মর্যাদাহানিকর অপবিশেষণের ঘৃণ্যতা থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলতে চাই, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এহেন অমর্যাদাকর হীনমন্য অপবিশেষণ কার ও কা'দের মস্তিষ্কপ্রসূত তা অবিলম্বে খতিয়ে দেখে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধার সংসদ।