ওয়াজেদুর রহমান কনক, নীলফামারী : ‘একটা অসাধারণ সময়ে মহিলা আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। এর আগের সময়টা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁর মাথার ওপর ফাঁসির দড়ি। পাকিস্থানী শাসকগোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করবার জন্য, পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এক বিশাল ষড়যন্ত্র করেছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সারা দেশ তখন উত্তাল। নারী-পুরুষ সকলে তখন রাজপথে, সকল পেশার মানুষ এই আন্দোলনে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বেড়িয়ে আসেন। এর ঠিক পাঁচ দিন পরে মহিলা আওয়ামী লীগের জন্ম। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমন একটা সময়ে বঙ্গবন্ধু মহিলা আওয়ামী লীগের জন্ম দেন যে সময়টাতে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে নারী পুরুষ সমান উদ্দোগ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু সেটি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি সে সময় নারীদের জন্য একটি আলাদা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের জন্ম দিয়েছিলেন।’

বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নীলফামারী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা জেলা কমিটির সভাপতি রোকেয়া ইসলাম রুপালীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন নীলপফামরী-২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর।এই সভার প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তিনি তুলে ধরেন।সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যডভোকেট মমতাজুল হক। বর্ধিত সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন মহিলা্ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সম্পাদক ড. জান্নাত আরা হেনরী, বিশেষ বক্তা ছিলেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতানা রাজিয়া পান্না।

বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও নীলফামারী পৌর সভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় বলেন, "এক সময় এই অঞ্চল ছিল অবহেলিত ও অনুন্নত। আমাদের এই অঞ্চল ছিল মঙ্গাপীড়িত। এখানে মানুষ না খেয়ে মারা যেত, এই অঞ্চলের স্থানীয় নেতৃত্ব হিসাবে আসাদুজ্জামান নূর দ্বায়িত্বে আসার পর থেকে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমউন্নয়নের মাধ্যমে আমরা আজ অনেক কিছু পেয়েছি।

আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারী। নারী সংগঠন আমাদের শক্তিশালী করতে হবে। নারী সংগঠন অন্যান্য সংগঠনের মতো নয়। আমাদের নারীর অংশগ্রহণ, আমাদের অর্ধেক ভোটার, যাদের কাছে আমরা পৌছুতে পারি না। নারী সংগঠন যদি আমাদের শক্তিশালী হয়, তাহলে প্রতিটি ঘরে ঘরে নৌকার জোয়ার আনতে পারবো। প্রতিটি গ্রাম গঞ্জে আমাদের নারী সংগঠন গুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।"

তিনি আরও বলেন, আজকে শুধু নাম লেখানোর জন্য সংগঠন করলে হবে না। অন্তর থেকে সংগঠন করতে হবে, শুধু মুখে মুখে সংগঠন করলে হবে না। ভোটের সময় নৌকা, ভোটের সময় অন্য মার্কায় ভোট দেবো, এমনটা করলে চলবে না। আগামীতে ২০২৩ সালের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে এই জেলায় যদি চারটি আসনে আমরা জয়লাভ করতে না পারি, তবে সরকার গঠন করা আমাদের সম্ভব নাও হতে পারে। এখন থেকেই আমাদের সুসংগঠিত হতে হবে। নৌকা যাতে ব্যাপক জয়লাভ করতে পারে এবং আমরা আবারো জননেত্রী হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই।

তার যে স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ করবেন, উন্নয়নশীল দেশে পরণত করবেন, তিনি তা সফল করেছেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছেন। তার যে স্বপ্ন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করবেন। এটি করতে হলে তাকে আবারো প্রধানমন্ত্রী হতে হবে। সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিটি অঞ্চলে, প্রতিটি এলাকায়, আমরা জনসভা করি, সেখানে শুধু পুরুষদের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেই হবে না, আমাদে মা বোনদেরও উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজুল হক বলেন, নিজেদেরকে আগে বুঝতে হবে। নিজেকে একজন পিতা মুজিবের সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অন্তরিকতার অভাই হলো বিড়ম্বনার কারণ। দেশের অর্ধেক ভোটার হলেন আমাদের নারীরা। কিন্তু এই অর্ধেক ভোটারের অর্ধেক ভোট নৌকায় আসে না।

আজকে জননেত্রী শেখ হাসিনা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রাণপ্রতিজ্ঞা করে ১৭ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। তাহলে এই ১৭ কোটি মানুষের অর্ধেক কারা? এই নারীদের ভোট থেকে আওয়ামী লীগ, নারীদের ভোট থেকে নৌকা মার্কা, নারীদের ভোট থেকে উন্নয়নের মার্কা, নারীদের ভোট থেকে বঞ্চিত হয় কেন?

সভার বিশেষ বক্তা রাজিয়া সুলতানা পান্না বলেন, " বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়ে বলেছিলেন আমার দেশের অর্ধেক নারী, এই নারীকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজকে বঙ্গবন্ধুর সেই কথার বাস্তব রুপ দিচ্ছে কে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি ১৮ ঘন্টা জেগে থাকেন।

হেনরী বলেন, এক সময় নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী নারীদের অনেক সুযোগ দিয়েছেন। এই সুযোগটা আমাদের নারীদের গ্রহণ করতে, নারীদের উপযুক্ত হতে হবে।

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি" গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে সভায় উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করে।

লন্ডনে অসুস্থ গাফফার চৌধুরীকে দেখতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান নূর তাঁর বক্তব্যে বলেন, তাঁর সাথে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, এর দু'দিন আগে ক্যান্সারে তার ছোট মেয়ে মারা গিয়েছে। সে সময়ও তার শরীরের অবস্থা ভালো ছিল না তিনি তার মেয়ের মৃত্যুতে যারপরনাই ব্যাথিত ছিলেন।

তিনি বলেন, আমরা এই অসাধারণ মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

আদর্শ থেকেই যেহেতু রাজনীতি করা, সে আদর্শের বহিঃপ্রকাশটা কিভাবে হবে। সময়ের দাবিতে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য সংগঠন গুলো জন্ম দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আগেই জন্ম হয়েছিল ছাত্রলীগের । ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠে। তারপরেই মহিলা আওয়ামী লীগের জন্ম। গুরুত্বটা বুঝতে হবে।

উপস্থিত মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, আপনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠনের সদস্য ।

আমরা সংগঠন করি, মিটিং করি, মিছিল করি । শ্লোগান দেই-জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলি । কিন্তু আমরা রাজনীতিটা সঠিকভাবে বুঝি কি না, বঙ্গবন্ধুর দর্শনটা বুঝি কি না-এটা নিয়ে অনেকেই আমরা সন্দীহান । এটা সব সংগঠনের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।

আমরা একটা আদর্শে বিশ্বাস করি। সে আদর্শের বহিঃপ্রকাশটা কিভাবে হবে । একটা আদর্শে বিশ্বাস করে আমি ঘরে বসে থাকলাম ! কোন কাজে লাগবে সমাজে ? সে আদর্শটাকে কিভাবে আমি আমার বাস্তব জীবনে, সমাজ জীবনে প্রতিফলিত করতে পারি, কিভাবে আমি সমাজের কাজে লাগবো-সেটা কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে ।

আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করি, আমি শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাস করি-কিন্তু এরজন্য আমি কিছু করি না, তাহলে দল করার কোন দরকার নাই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শটাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে । এটা বোঝার জন্য খুব পন্ডিত হওয়ারও দরকার নাই ।

কেউ যদি মনে করেন গ্রামের সাধারণ মেয়ে মানুষেরা কিছু বোঝে না-এটা ভুল কথা। তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমতি। তারা মাঝে মাঝে এমন সব প্রশ্ন করে যে অনেক সময় বেকায়দায় পড়ে যেতে হয়। তাদের কাছেও আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।

আমাদের এই দেশটা কেমন ছিল, আমাদের এই অঞ্চলটা কেমন ছিল। আশ্র্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণে এই অঞ্চলে মঙ্গা হয়। এই এলাকায় প্রবাদ ছিল ‘হাতিকে ঠেলা গেলেও কার্তিক ঢেলা যায় না’ । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, কিভাবে ? নীলফামারীর মেয়েরা এখন ইপিজেটে চাকুরী করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নারীদের আজকে এই জায়গায় এনেছেন।

একথা বহুবার বলা হয়েছে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এজন্য তিনি নারী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন, ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়েছেন।

সভায় জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাক ফরিদা খানম এনার সঞ্চালনায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের রাবেয়া আলীম, মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক রোকেয়া প্রাচী, সংগঠনটির প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মরিয়ম বিনতে হুসাইন খেয়া, সদস্য সহিদা চৌধুরী তন্বী, আঞ্জুমান আরা বেগম বন্যা, সদস্য জাকিয়া খাতুন।

(ওআরকে/এএস/মে ২০, ২০২২)