আবীর আহাদ


আবার তিনি মুখ খুলেছেন। তাঁর মুখখোলার অর্থ একরাশ মিথ্যাচারের ফুলঝুরি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুরের কথাই বলছি। তিনি নাকি বলেছেন, আসছে জুন মাসের মধ্যেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবেন। তাদেরকে স্মার্টকার্ড প্রদান করবেন। কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলেও সেগুলো যে অন্তঃসারশূন্য তা বলাই বাহুল্য। অতীতে এরকম অগণন প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন কিন্তু ফলাফল অশ্বডিম্ব! তাই আমরা তার কথা এ-কান দিয়ে শুনি, আর সেটি ও-কান দিয়ে অটো বেরিয়ে যায়! এবারও তার কথা যে কল্পনার ফানুস হবে না তা কে জানে!

আসছে জুন মাসের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুর এবার নাকি কোমর বেঁধে ঝেড়েকেঁশে নেমেছেন। তা যদি সত্য হয় তাহলে তাঁকে একটা সাধুবাদ জানানো হবে। তবে সাধুবাদের পূর্বশর্ত হতে হবে, প্রকাশিব্য সে তালিকা যেনো শুধুমাত্র প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়। কারণ আমাদের বদ্ধমূল ধারণা এই যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধাসহ বিরাটসংখ্যক রাজাকার অবস্থান করছে।

আমরা জানি যে, গত ৫০ বছরে অন্তত সাতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের বিষয়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। এখন নতুন প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, জুন মাসের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। সেই সাথে প্রদান করা হবে ডিজিটাল স্মার্টকার্ড।

সূত্রে প্রকাশ, যাঁদের ব্যাপারে জেলা-উপজেলায় তদন্ত কার্যক্রম চলছে, তাঁরা এ তালিকা থেকে আপাতত বাদ থাকবেন। আগে ১ লাখ ৯৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে মাসে ভাতা পাঠানো হতো। ভাতা পাওয়া সব বীর মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করার পর এ সংখ্যা নাকি অনেক কমে এসেছে। অর্থাত্ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বসাকুল্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১লক্ষ ৮৬জন। কিন্তু আমাদের জানামতে গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৫ হাজারের মতো। তাহলে প্রকৃত সংখ্যা কোনটি?

মুক্তিযোদ্ধা কম বা বেশি সেটি বড়ো কথা নয়। মূল কথাটা হলো, কোনো প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা যেমন তালিকার বাইরে থাকবেন না, তেমনি কোনো অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় থাকবে না। একটা কথা সরকারসহ সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে যে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও তিতিক্ষা দিয়ে দেশটা স্বাধীন করেছিলেন বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন। এ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করলে মঙ্গল। কিন্তু আমরা কী দেখছি? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু সমাজে জাতে ওঠার জন্যে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একটা দুর্বৃত্তচক্র রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে!

বিশেষ করে অতীত ও বর্তমান ক্ষমতার সাথে জড়িত, দুর্নীতি, লুটপাট ও অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী, এমপি, মন্ত্রীদের কেউ কেউ সামান্য মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ও মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনারে ভাগ বসানোর জন্যে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন এবং হচ্ছেন! বিশেষ করে রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতাবানদের নিকটজনদের অনেকেই এ অপকর্মের সাথে জড়িত! তাদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও বা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও মূল-ক্ষমতাবানদের মধ্যে যখন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তখন ধরে নেয়া যায় যে, এ অপকর্মে তাঁদেরও সায় রয়েছে! অথবা তাঁরা তাদের খুশি দেখতে চান!

আমাদের কথা পরিষ্কার। যতোই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করুন, করেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কেবলমাত্র প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই থাকবেন। জামুকা নামক জাল মুক্তিযোদ্ধা তৈরির মেশিনটি বাতিল করতে হবে। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণে বঙ্গবন্ধু সরকারের ৭২ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে উচ্চ আদালত, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠন করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। অন্যান্য দাবির পাশাপাশি এ দাবিটিও আমরা গত কিছুদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশকৃত স্মারকলিপিতে সন্নিবেসিত করেছি। বল এখন জামুকা তথা সরকারের পায়ে। তারা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় খেলবেন সেটা তাদের এখতিয়ার। আমরা চাই সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা। এটার সাথে কোনো প্রকার আপোস নয়; এটা "বীর মুক্তিযোদ্ধা" নামের ঐতিহাসিক গরিমা ও মর্যাদার প্রশ্ন।

লেকক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।