কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : ভারতীয় কাষ্টমস ফ্রি এলসি’র চাল দেশে আসায় দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর এলাকায় চালের ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে শত শত শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে অভাব অনটনে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সামনের দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকা করছে চাল মিল মালিক, ব্যবসায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত হাজার হাজার মানুষেরা।

অধিক সুদে ব্যাংকের নেয়া ঋণ মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় সরকার ভারতীয় এলসি চাল দেশে আনা বন্ধ না করলে এই অঞ্চলের চাল মিল এবং ব্যবসায়ীরা মারাত্বক ক্ষতির মধ্যে পড়বে যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে মারাত্বক আঘাত হানতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

দেশের বৃহত্তর চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর, বটতৈল ও কবুরহাট এলাকা ঘুরে দেখো গেলে ভারতীয় এলসি চাল দেশে আসার প্রভাব ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। অনেক চাতাল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে এখানকার ব্যবসায়ী ও মিল মালিকেরা। চাতালে কর্মরত শত শত নারী এবং পুরুষ শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ভারতীয় চাল কাষ্টমস ফ্রি হওয়াতে সেই চাল বাজারে কম মূল্যে বিক্রি হওয়াতে এখানকার উৎপাদিত চাল বিক্রিতে ব্যবসায়ীরা মার খেয়ে যাচ্ছে। গত ২ মাস থেকে এই চাল বেশির ভাগই বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে আসছে। কাষ্টমস ফ্রি হওয়াতে এই চাল সহজেই দেশীয় তৈরী চালের থেকে কম মূল্যে বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা।

ভারত থেকে আসা চালের মধ্যে রয়েছে, নবান্ন, বিজয় ভোগ, জয় ভোগ, সানন্দা ভোগ, বর্ধমান ইত্যাদী। ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের এই চাল বাজারে ৩৯.৫০ টাকা করে কেজি আর দেশী চাল ৪৩ টাকা কেজি। মোটা বাংলাদেশের নুরজাহান মোটা চাল ৩৩ টাকা আর ভারতের মোটা চাল বাজার মুল্যে ৩০.৫০ টাকা কেজি। বাংলাদেশের কাজল লতা মিনিকেট ৩৭.২০ টাকা কেজি আর ভারতের ৩৫.৫০ টাকা কেজি।

ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের চাল কমপক্ষে ২ বছর গোডাউনে রাখা চাল। এই চালে ক্যামিকেল মিশিয়ে গোডাউনজাত করা হয়। এই চালের গুনগত মান ভাল না এবং এতে শারীরিক সমস্যার কারন হতে পারে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। বর্তমান দেশী তৈরী চালের বাজার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দেশী চালের খরচ বেশি হওয়াতে ভারতীয় চালের প্রভাবে বাজারে দেশী চাল বিক্রি কম হচ্ছে ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা বেহাল অবস্থার মধ্যে আছে।

বর্তমান অবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চাতাল ও মিল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে মালিকেরা। কুষ্টিয়া চাল প্রসেসিং মিল মালিক সমিতির অফিস সহকারী টিপু সুলতান জানান, কুষ্টিয়ায় ২৫টি অটো রাইস মিল। ৫৭টি চাল প্রসেসিং মিল এবং ৪ শতাধিক রাইস মিল আছে। এছাড়া প্রতিটি মিলে গড়ে ৪টি করে চাতাল হিসেবে মোট ১৬ ’শ বেশি চাতাল রয়েছে। আর এসব চাতালে প্রায় ১০হাজার নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করে থাকে।

তিনি জানান, ইতিমধ্যে ৫টি প্রসেসিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক চাতালে ধান সিদ্ধ ও শুকানো বন্ধ রয়েছে। এসব চাতালের শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় তারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছে। আবার অনেক চাতাল চলছে ঢিমেতালে। তবে কোরবানীর ঈদের পর এখানকার পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে উঠবে বলে তিনি জানান। বন্ধ হওয়া মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে সিটি এগ্রোফুড, ফাতেমা এগ্রো, লিফ-রাসেল এগ্রোফুড অন্যতম। আল্লার ইচ্ছা রাইস মিলের জামিরুল ইসলাম জানান, আমাদের ৪টি চাতালের মধ্যে ৩টি বন্ধ রয়েছে। আর একটি কোনভাবে চলছে। ৩ মাস ধরে এগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।

তিনি জানান, এখানকার অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে আর ঈদের পর আরো অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে যাবে।

কুষ্টিয়া চাল প্রসেসিং মিল মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক হাজী শরিফুল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়ার চাল মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের অবস্থা শোচনীয়। ভারতীয় কাষ্টমস ফ্রি চাল অবাধে দেশে আসায় প্রকৃত চাল ব্যবসায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত হাজার হাজার পরিবার পথে বসতে বসেছে। ব্যাংকের চড়া সুদে নেয়া ঋণ সকলের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়ছে। বাজারে ব্যবসা নেই। ভারতের চালের কারনে লোকশানে চাল বাজারে ছাড়তে হচ্ছে এভাবে আর কতদিন পারবো তা বলতে পারছি না।

তিনি জানান, মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের চড়া সুদ প্রতি মুহুর্তে সকলকে যন্ত্রনা দিচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কোরবানীর পর এই চাল শিল্পের করুন পরিনতি হবে। তিনি অবিলম্বে সরকারকে ভারতীয় কাষ্টমস ফ্রি চাল দেশে প্রবেশ বন্ধ করার আহবান জানান।
এদিকে, ভারতীয় চাল বিক্রেতা গড়াই রাইস এজেন্সীর হাজী সদর উদ্দিন বিশ্বাস বলছেন ভিন্ন কথা। তার মতে ভারতীয় চাল দেশে আসায় বর্তমান দেশে চালের দাম উর্ধগতিকে নিম্নমুখি করে বাজারকে ঠিক রেখেছে। তিনি জানান, অধিক মুনাফাখোর মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা দেশের চালের বাজারকে নিয়ন্ত্রন করে চলেছে। আজ ভারতীয় চাল দেশে আসায় তারা মারাত্বক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে তবে দেশের সাধারন মানুষ কম মূল্যে ভাল চাল কিনে খেতে পারছে। চালের গুনগত মানের বিষয়ে তিনি জানান, এ চালে কোন কেমিকেল নেই। সুন্দর ভাত হয়। মানুষ এই চালকে বেশি ভাল জেনে কিনছে। তাতে দেশের মানুষেরা উপকৃত হচ্ছে।

(কেকে/এএস/অক্টোবর ০১, ২০১৪)