শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ‘হোজির নদী’ দখল করে মাছ চাষের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় ২০ নেতাকর্মী বিরুদ্ধে। এসব প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের মাছের ঘের (খামার) উচ্ছেদ করে গত শুস্ক মৌসুমে ভরাট হয়ে যাওয়া এই নদীটি পুন:খননে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। 

পুন:খননের পরপরই ওইসব নেতারা আবারো হোজির নদীর অন্তত ৩টি স্থানে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। ফলে, প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পুন:খনন করা এই নদীর কোন সুফল পাচ্ছে না এলাকাবাসি। বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে হোজির নদী পুন:খননের পর ফের দখল হয়ে যাবার বিষয়টি তাদের জানা নেই। তবে, পুন:খননের পর ফের দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জনিয়েছেন বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডেমা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের খেগরাঘাট ও ৫নং ওয়ার্ডের কাশিমপুর গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া হোজির নদীর উপর নির্মিত ব্রীজের নিচ থেকেসহ অন্তত ৩টি স্থানে বাঁধ দিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় ২০ নেতাকর্মী মাছ চাষের সুবিধার জন্য পানির প্রবাহ বাাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছে। ওইসব বাঁধের উপর নির্মান করা হয়েছে ঘের পাহারাসহ মাছ চাষের খাবার ও বিভিন্ন মালামাল রাখার খুপড়ি ঘর।

এসময় মৎস্য ঘের রক্ষনাবেক্ষনের জন্য নিয়োজিত কয়েকজন এগিয়ে আসলে কথা হয় তাদের সাথে। নাম প্রকাশ না শর্তে তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এখানে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন তারা। নদীতির মাঝখানের এই ব্রীজটির নিচের এই বাঁধ দিয়ে ঘেরের দুটি অংশ ভাগ করে স্থানীয় ২০ নেতাকর্মী মাছ চাষ করছেন।

নদী পাড়ের বাসিন্দা বৃদ্ধ কালাম শেখ বলেন, হোজির নদীতে এক সময় বড় বড় নৌকা লঞ্চ চলতে দেখেছি। একটা সময় পলি মাটিতে গভীরতা কমে গিয়ে ছোট হয়ে যায় নদীটি। মূলত সেই থেকেই নদীটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। এরপর যে দল যখন ক্ষমতায় থেকেছে সেই দলের লোকজনই প্রভাব খাটিয়ে নদীটি দখল করে মাছ চাষ করছে। এখন নদীটি পুন:খননের পর ফের তিনটি বাঁধ দিয়ে দখল করে আওয়ামী লীগের লোকজন মাছের ঘের করছে।

কাশিমপুর গ্রামের বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা বছরের পর বছর ধরে নদীটিতে মাছ চাষ করে আসচ্ছে। সম্প্রতি নদীটি পুনখনন করা হয়েছে। ইউনিয়নের জলাবদ্ধতা নিরাশন ও কৃষকদের ধান চাষে এ নদীটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে নদী খনন করে আমাদের কি লাভ হলো। এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলাম হুসিসহ বেশ কয়েকজন প্রভাব খাটিয়ে নদীটি বছরের পর বছর ধরে দখল করে রাখলেও কখনও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়না প্রশাসন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠফোনে ডেমা ইউনিয়েনের ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম হুসি নদী দখল করে মাছ চাষের কথা স্বীকার করে বলেন, শুধু আমি একা না, ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার ও ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফরিদ মোল্লা, ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক নকিব হাই, ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফরাদ শেখ ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য সাইফুল ফকিরসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ২০ জন রয়েছে। এরা সবাই হোজির নদীর এই ঘেরের অশিংদার।

নদীতে বাঁধ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বাঁধ আমরা দেয়নি। নদী খননের সময় খননের সুবিধার জন্য এই বাঁধ দেয়া হয়েছিলো। আমরা শুধু খুপড়ি ঘর ও নদীর পানি প্রবাহের জন্য একটি পকেট গেট নির্মান করেছি। এ বছর এখন পর্যন্ত আমাদের প্রায় ৭ লাখ টাকার গলদা, বাগদা, রুই ও কাতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছেড়েছি এখানে। নদী দখল করে মাছের চাষ বৈধ কি না জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এটা অবৈধ আমরা সবাই জানি। প্রায় ৩০/৩৫ বছর ধরে এই নদীতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। কেউ কোন কখনও বাধা দেয়নি। প্রশাসন না চাইলে আমরা মাছ চাষ করবো না।

বাগেরহাট সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মোছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, ডেমা ইউনিয়নের হোজির নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে জনতে পেরেছি। ইতিমধ্যেই বাঁধ অপসারন করে মাছ চাষ না করার জন্য ওই এলাকায় মাইকিং করতে ডেমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সরোজমিন পরিদর্শন করে দ্রুত বাঁধ অপসারনে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও জানান তিনি।

ডেমা ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক লীগের সাধারন সম্পাদক মনি মল্লিক বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে ওই এলাকায় মাইকিং করে যারা নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন তাদের সবাইকে সর্তক করা হয়েছে। নদীটি দখলমুক্ত করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ মুঠোফোনে বলেন, হোজির নদী পুন:খননের পর ফের দখল করে মাছ চাষের বিষয়টি আমার জানা নেই। সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে হোজির নদীটি পুন:খননে বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এব্যাপারে দ্রুত খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এবার কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।

(এসএকে/এসপি/জুন ৩০, ২০২২)