নাটোর প্রতিনিধি : আর মাত্র দুই দিন পর কোরবানির ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ চামড়ার মোকাম নাটোরের আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা পশুর চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। শহরের চকবৈদ্যনাথ এলাকায় গড়ে ওঠা আড়তগুলিতে শুরু হয়েছে ধোয়ামোছা ও সংস্কার কাজ।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৌসুমি, ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও ঢাকার ট্যানারী মালিকরাও কোরবানির চামড়া কিনতে আনাগোনা শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পশুর চামড়ার দর নির্ধারন করে দিয়েছে ট্যানারী মালিকরা। এবার প্রতিস্কায়ার ফিট চামড়ার দর নির্ধারন করা হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বর্তমানে প্রতি ফুট গরুর চামড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকায় কিনছেন বলে সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছেন। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঈদুল আজহার আগেই ঢাকার ট্যানারী মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম অনেকাংশেই কমিয়ে দিয়েছে। একই সাথে চামড়া কেনার ক্ষেত্রেও অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। অপরদিকে ঢাকার ট্যানারী মালিকদের কাছে থেকে ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের প্রায় ৩০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলেও দাবী করেন ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছে বকেয়া থাকায় ব্যবসায়ীদের অনেকেই পুজি সংকটে ভুগছেন। এতদ স্বত্বেও ব্যবসায়ীর চামড়া কেনা বেচার জন্য তৎপর রয়েছেন এবং পুজি সংকট থাকলেও তারা চামড়া সংরক্ষনের স্থান প্রস্তুত করে রাখছেন। তবে দু’একদিনের মধ্যে বকেয়া টাকা পাওয়ার আশা করছেন তারা। ব্যবসা চালু রাখতে প্রয়োজনে টাকা ধার করবেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে এরপরেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ চামড়ার আড়ত নাটোরে অন্যান্য বছরের মত এবারও রেকর্ড পরিমান কোরবানির চামড়া বেচাকেনার সম্ভাবনা রয়েছে। এবারের ঈদ মৌসুমে অন্তত ৪ থেকে ৫শ’ কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হবে। এবার চামড়ার দাম কম হওয়ায় ভারতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। ব্যবসায়ী সুত্রমতে ভারতে চামড়ার বাজার দর বাংলাদেশের চেয়ে ৪-৫ ’শ টাকা বেশি। যে কারনে অধিক মুনাফা লাভের আসায় বাংলাদেশ থেকে কম মুল্যে চামড়া কিনে ভারতে বিক্রি করতে তা পাচার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতে চামড়া বিক্রির জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ইতিমধ্যেই প্রস্তুত রয়েছেন। তবে অনেকেই পাচার হওয়ার বিষয়টি নাকচও করে দিয়েছেন।

স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতি সুত্রে জানা যায়, নাটোরে আড়তদার সহ ছোটবড় প্রায় ৩ হাজার চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫০ টি আড়ত রয়েছে। এখানে সারা বছর ধরে চামড়া কেনাবেচা হয়। গত বছর ঈদুল আজহার সময় অ্যানথ্রাক্স আতংক থাকায় পশু কোরবানী কম হলেও নাটোরের চামড়া মোকাম থেকে প্রায় সাড়ে ৩’শ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। এবার ৪ থেকে ৫ ’শ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, গত বছর কোরবানীর ঈদে নাটোরে শুধু মাত্র ৪ দিনে ১০০টি চামড়ার আড়তে প্রায় ১৫০ ট্রাক গরুর চামড়া (৭৫ হাজার পিচ), ৫০ ট্রাক বকরি বা ছাগলের চামড়া(৬০ হাজার পিচ), ১০ ট্রাক মহিষের চামড়া (১০ হাজার পিচ) ও ১০ ট্রাক মাথানী চামড়া( ১২ হাজার পিচ) কেনাবেচা হয়। প্রতিটি চামড়া (গরু )গড়ে ২৫ ফুট, ছাগল সাড়ে চার ফুট ও মহিষ ৩২ ফুট দৈর্ঘ্য চামড়া পাওয়া যায়। চামড়া কেনা-বেচা হয় গরু প্রতি পিচ ৯০ টাকা ফিট হিসাবে ২২’শ টাকা থেকে ২৮’শ টাকায়, বকরি বা খাসির চামড়া কেনা-বেচা হয় ৪৫ টাকা ফিট হিসাবে প্রতি পিচ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকায়, মহিষের চামড়া ১৯’শ থেকে ২১’শ টাকায়। এর সঙ্গে ক্রয়কৃত চামড়া প্রস্তত ( লবন ও কামলা) করতে প্রতি পিচে আরো ১০০ টাকা খরচ হয়।

স্থানীয় আড়তদার বিরেন্দ্র নাথ চৌহান জানান, গত বছরের তুলনায় এবার চামড়ার দাম আরো কম হবে। কারন এবার ভারত থেকে যে ভাবে গরু আমদানি হচ্ছে এবং কোরবানির গরু বিক্রি হচ্ছে। তাতে গুরুর চামড়ার পরিমান বিগত বছরের তুলনায় বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবছর এখনই চামড়ার অনেক বাজার কম। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চামড়া ব্যবসায়ী জানান, ট্যানারি মালিকরা যদি চামড়া বেশি দামে না কেনেন, তাহলে চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যাবে। গত বছর বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ভারতে পাচারও করেছেন।

চামড়া ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিক জানান,নাটোরের আড়তে ঈদ মৌসুম ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে গড়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার চামড়া বেচা কেনা হয়। দেশের চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ চামড়া আসে কোরবানির ঈদে,২০ ভাগ শবেবরাতে এবং অবশিষ্ট ৪০ ভাগ অন্যান্য সময়ে। এজন্য ভারত থেকেও অনেক সময় চামড়া আমদানি করতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চামড়া ব্যবসায়ী জানান, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের মানসিক চাপে রাখতে ভারতে চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী তায়জুল ইসলাম জানান, আড়তদারদের বেকায়দায় ফেলে আরো সস্তায় কেনার জন্য বড় ব্যবসায়ীরা ঈদের পর যখন চামড়ার ব্যাপক আমদানী ঘটে তখন নাটোরে না এসে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মানসিক চাপে ফেলে রাখে। পরে কম মুল্যে ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়। তার মতে, এ বছর ঈদুল আজহার আগেই ঢাকার ট্যানারী মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে। ঢাকার আনোয়ার ট্যানারির প্রতিনিধি রেজাউল করিম জানান,বেশী দামে চামড়া কিনে লোকসান হয়ে থাকে। একারনে তারা চামড়া কিনতে রাজি হন না। ট্যানারি মালিকদের মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে মৌসুমী ও অসাধু কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেড করে ভারতে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার কথা প্রচার করে থাকে বলে তারা ধারণা করেন। নাটোর থেকে ভারতে চামড়া পাচার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানান। স্থানীয় অপর চামড়া ব্যবসায়ী বদরুদ্দিন কোরাইশী বলেন,ঈদে কাঁচা চামড়া কেনার জন্য ঢাকার টেনারি মালিকদের ব্যাংক ঋণ দেয়া হলেও তারা কাঁচা চামড়া কেনেন না। অথচ যারা আড়তদার বা স্থানীয় ব্যবসায়ী তাদের কাঁচা চামড়া কেনার জন্য সরকারীভাবে আর্থিক সহায়তা দিলে কখনই চামড়ার বাজার এমন হতোনা। এছাড়া কাঁচা চামড়া পাচার রোধে চামড়া রফতানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে চামড়া ব্যবসায় একদিকে যেমন প্রতিযোগীতার পথ সুগম হবে। অপরদিকে চামড়ার প্রকৃত মুল্য ও পাচার বন্ধ হবে।
চামড়া ব্যবসায়ি সমিতির সাধারন সম্পাদক সায়েদার খান জানান, ঈদের পরে ২/৩ সপ্তাহজুড়ে ব্যবসায়ীদের কাছে দিন-রাত এক হয়ে যায়। এ সময়ে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল সহ প্রায় ৩০টি জেলার ছোট বড় প্রায় দেড় হাজার ব্যবসায়ী এবং ৫০ টির মত ট্যানারী মালিক প্রতিবছর নিয়মিতভাবেই নাটোরের চামড়ার আড়তে বেচা-কেনা করেন।

নাটোর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি এসএম মকছেদ আলী জানান, উত্তোরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা নাটোর মোকামে এসে চামড়া বেচা কেনা করে। ঈদ মৌসুমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অন্য পেশায় নিয়োজিত এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ তাদের জমানো টাকায় ঈদের সময় চামড়া কেনেন। অনেক বেকার যুবকও তখন এই কর্মে সাময়িকভাবে যুক্ত হয়। নাটোরের মোকামে প্রায় ১৫০টি আড়ত সহ প্রায় ৩হাজার’ ব্যবসায়ী রয়েছে। স্থানীয় আড়তদাররা নগদ টাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে চামড়া কিনলেও ঢাকার মালিকরা টাকা পরিশোধ করতে বিলম্ব করেন। ঢাকার মালিকদের কাছে বকেয়া থাকার কারনে অনেক সময় স্থানীয় আড়তদাররা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বকেয়ো সময়মত পরিশোধ করতে পারেননা। ঢাকার মালিকদের কাছে নাটোরের ব্যবসায়ীদের বর্তমানে অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। এ কারনে ৫০টির মত আড়ত সচল রয়েছে । বাকিগুলো চলছে ধুকে ধুকে। এবার ট্যানারী মালিকরা বিনিয়োগে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এবার ভারতে চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি জানান।

(এমআর/অ/অক্টোবর ০৩, ২০১৪)