গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু


গত দুদিন ধরে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বারবারই ফোন পাচ্ছিলাম। এদের সকলেরই একটি প্রশ্ন, সদ্য অনুষ্ঠিত নবীনগরে 'বিএনপির 'তাক্ লাগানো' এমন একটি সাড়া জাগানো, সফল সম্মেলন হওয়ার পরও এ নিয়ে আমার কোন রিপোর্ট কিংবা লেখা নেই কেন?

এক্ষেত্রে সকলের জ্ঞাতার্থে সবিনয়ে জানাতে চাই, গত ৩০ এপ্রিল নবীনগরে বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আর আমি ২৯ এপ্রিল থেকে ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতীয় একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করি। সেজন্য সাড়া জাগানো বহুল আলোচিত এই সম্মেলনটি আমার দেখার সুযোগ হয়নি।

তবে ঢাকা থেকে নবীনগরে এসে বিএনপি, আওয়ামীলীগসহ বিভিন্ন সাংবাদিক ও স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানতে পেরেছি, হাজার হাজার নেতাকর্মী সমর্থকদের স্বতস্ফুর্ত উপস্থিতিতে নবীনগরে এ যাবৎকালে স্মরণকালের একটি সাড়া জাগানো সফল ও শান্তিপূর্ণ সম্মেলন করতে পুরোপুরি সক্ষম হয়েছে নবীনগর উপজেলা বিএনপি।

বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিগত দিনে বহু মামলা, হামলাসহ শত প্রতিকুলতার মধ্যেও বিএনপি কিভাবে প্রায় দেড় যুগ পর নবীনগরে এমন একটি সফল সম্মেলন করতে সক্ষম হলো? এমন প্রশ্ন করেছিলাম সম্মেলনের দায়িত্বে থাকা দলটির আহবায়ক ও বর্তমানে সভাপতি নির্বাচিত হওয়া এমএ মান্নানের কাছে। জবাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নবীনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি পদে পুনরায় নির্বাচিত হওয়া এডভোকেট এম এ মান্নান আমাকে জানান, 'এটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকদের দলের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের কারণে। প্রায় ১৫/১৬ বছর পর যখন গত ৮ মাসে আগে আমাকে নবীনগর বিএনপির 'আহবায়ক' হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন থেকে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডে গিয়ে গিয়ে আমরা কমিটি করে দিয়েছি।

এভাবে তৃণমূলের সব কমিটিগুলো (একটি ইউনিয়ন ছাড়া) হওয়ার পর আমরা সবাইকে সম্পৃক্ত করে তবেই সম্মেলনটি করেছি। আর সেজন্যই প্রায় ৮/১০ হাজার বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকদের স্বতস্ফুর্ত উপস্থিতি এবং জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের আন্তরিক সহযোগিতায় স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে সফল একটি সম্মেলন আমরা অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে পেরেছি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই যে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী সমর্থকেরা সম্মেলনে এসেছেন, তাদের আসা যাওয়ার ভাড়া ও খাওয়ার টাকা পয়সা কিন্তু আমরা দিতে পারিনি। সবাই নিজেদের টাকা খরচ করে এসেছেন এবং নিজেরা খাবার রান্না করে নৌকায় করে সম্মেলন স্থলে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যেও এটি বিএনপির প্রতি বিশেষ করে আমাদের আদর্শিক নেতা দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়া, আমাদের দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার প্রতি প্রতিটি নেতাকর্মীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শতভাগ আস্থারই প্রতিফলন। সেজন্য আমি নবীনগর বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী সমর্থককে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও মোবারকবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

বিএনপির সম্মেলনের দিনে আমি ঢাকায় থাকলেও, সম্মেলনের দুদিন পর নবীনগরে এসে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, একটি দলের উপজেলা সম্মেলনে হাজার হাজার নেতাকর্মীদের এমন স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিলো সত্যিই অভাবনীয় ও রীতিমত একটি বিরল ঘটনা। তবে সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে একমাত্র সেক্রেটারী পদে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি নিয়ে অনেকেরই নানা প্রশ্ন ছিলো। সম্মেলন নিয়ে কারও কোন অভিযোগ না থাকলেও, ২০ টি ইউনিয়নের ১৪২০ জন কাউন্সিলরের ছবিবিহীন ভোটার তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ থাকা, স্লিপ সিস্টেম করা, ভোট কিনতে কালো টাকার ছড়াছড়ি, একজন প্রার্থীকে ঠেকাতে পূর্বাঞ্চচলের একজন বহুল আলোচিত তরুণ নেতার সর্বোচ্চ হস্তক্ষেপসহ নানা অভিযোগের কথা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি।

এ বিষয়ে কথা বলতে নবনির্বাচিত বিএনপির সেক্রেটারী নাজমুল করিমের মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারিনি। পরে পরাজিত সেক্রেটারী প্রার্থী নবীনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর প্রশাসক মো. মলাই মিয়া বলেন,'সারাদেশের প্রেক্ষিতে আমরা যেখানে পুলিশী বাঁধায় একটা মিছিল করতে পারিনা, সেখানে শত প্রতিকুলতার মধ্যেও হাজার হাজার নেতাকর্মীসমর্থকদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে এমন শান্তিপূর্ণ ও সফল সম্মেলন এর আগে কখনও নবীনগরে কেউ করে দেখাতে পারেনি, এটি আমি জোর গলায় বলতে পারি। সেজন্য আমি তৃণমূল বিএনপির প্রতিটি নেতা কর্মী সমর্থকদেরকে আমার পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন ও স্যালুট জানাই।

সম্মেলনে আমাদের প্রিয় নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারুণ্যের অহংকার তারেক জিয়ার নির্দেশমতে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষভোটে যেভাবে সেক্রেটারী পদে নির্বাচনটি হয়েছে, সেটি অন্য যেকোন দলের জন্যই নি:সন্দেহে অনুকরণীয়। তবে নির্বাচনটিতে নানা ত্রুটি থাকলেও, প্রত্যক্ষ ভোটে যে পদ্ধতিতে নির্বাচনটি হয়েছে, সেজন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।

নির্বাচনে নানা ত্রুটির বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে নবীনগরে বিএনপি নামক দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম, ত্যাগী ও বিএনপির আদর্শিক নেতা মো. মলাই মিয়া বলেন,'আপনারা সাংবাদিকেরা একটু ভালো করে মনযোগ দিয়ে অনুসন্ধ্যান করলেই নির্বাচনে কি কি ত্রুটি ছিলো, তার সবগুলোই পানির মতো বের করতে পারবেন। তবে এরপরও আমি খুশী। গত কয়েক বছর ধরে চক্রান্তবারীরা আমাকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে নানা ষড়ন্ত্রের পর এবং নির্বাচনে নানা ত্রুটি থাকার পরও তৃণমূলের নেতারা আমাকে ভালোবেসে ৫২০টি ভোট দিয়েছেন। সেজন্য তাঁদের কাছে আমি ঋণী। জানিনা সেই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো কি না। তবে যতদিন বাঁচবো, তাদের এই ঋণ মনে রেখে শহীদ জিয়ার আদর্শ বুকে ধারণ করেই বিএপির একজন সাধারণ কর্মী হয়ে আজীবন দলের জন্য কাজ করে যাবো। কারণ, নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পরও এবারের সম্মেলনে নেতাকর্মী সমর্থকদের যে ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা পেয়েছি, সেটিই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও শক্তি।"

প্রসঙ্গত, সম্মেলনে সেক্রেটারী পদে সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপির সর্বশেষ আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব নাজমুল করিম ৫৮৬ ভোট পেয়ে (মলাই মিয়ার চেয়ে ৬৬ ভোট বেশী) নবীনগর উপজেলা বিএনপির সেক্রেটারী পদে নির্বাচিত হয়েছেন।

এছাড়া 'সভাপতি' পদে এম এ মান্নান ও 'সাংগঠনিক সম্পাদক' পদে উপজেলা যুবদলের সাবেক সেক্রেটারী আশরাফ হোসেন রাজু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগেই নির্বাচিত হন।

এদিকে নবনির্বাচিত সভাপতি এম এ মান্নান জানিয়েছেন, খুব শিগগীরই দলের সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে নবীনগর উপজেলা বিএনপির একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। তবে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিএনপির ত্যাগী ও আদর্শিক নেতাদেরকেই স্থান দেওয়া হবে।

পাদটিকা: শত প্রতিকুলতার মধ্যেও হাজার হাজার নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে নানাভাবে কোনঠাসা বিরোধীদল বিএনপির এমন তাক্ লাগানো ও সাড়া জাগানো একটি সফল সম্মেলনের পর সকলেরই দৃষ্টি এখন নবীনগর উপজেলা আওয়ামীলীগের আসন্ন সম্মেলনের দিকে।

আওয়ামীলীগ সরকারি দলে থেকে আসন্ন সম্মেলনটি কতটা তাক্ লাগানো কিংবা সাড়া জাগাতে পারবে, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে সচেতন নবীনগরবাসী!

লেখক : সম্পাদক, নবীনগরের কথা ও বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক বাংলা ৭১।