স্টাফ রিপোর্টার : বে-দখলদারকে দখলদার ও প্রকৃত মালিককে দখল নাই বলে উল্লেখ করে উপজেলা ভূমি অফিসে প্রতিবেদন পাঠালেন ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা। সার্ভেয়ার প্রতিবেদন দিলেন আবেদনকারীর অনুকূলে সব ঠিক আছে, তখনই সহকারি কমিশনার (ভূমি) মুল খতিয়ানকে রাতারাতি পাল্টে দিলেন। এমনকি খতিয়ান সৃজন করে অনলাইনে ইনপুট দিলেন। অথচ অফিসের কাগজে কলমে আর বালামে এ খতিয়ানের কোন অস্তিত্ব নেই। 

ভুক্তভোগির এমনই অভিযোগ চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার সাবেক সহকারি কমিশনার (ভূমি) শিরীন আক্তার, চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা উজ্জ্বল কান্তি দাশ, নাজির দেবাশীষ রুদ্র, সার্ভেয়ার মোঃ ইউনুস ও অফিস সহকারি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে।

ভূমি অফিসের এই পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে আর অনিয়মেই ২০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি দাবি করেছেন ভুক্তভোগী। জমির মালিক কানাডা প্রবাসী তৌহিদুর রহমানের পক্ষে ‘এটি এজেন্সীর’ ম্যানেজার মোঃ আনোয়ার হোসেন এমন অভিযোগ করে (৩রা আগস্ট) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কাছে এদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন।

লিখিত অভিযোগে জানা যায়, অভিযোগকারীর মালিক মৃত মোঃ আইয়ুব মিয়া ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের ভোগ দখলীয় জমি। চরপাথরঘাটা ইছানগর মৌজার ৩৮৭ নং খতিয়ানে ৩০ শতক। যা এসিল্যান্ড শিরীন আক্তারের নিজ স্বাক্ষরিত খতিয়ান সৃজিত। এমনকি ৫০৩নং খতিয়ানে ৯২.৫০ শতক জমি। যা অনুমোদন করেছিলেন তৎকালীন এসিল্যান্ড মারুফা বেগম নেলী। কিন্তু এসিল্যান্ড নিজেই খতিয়ান সৃজন করে দিয়ে আবার বদলি হয়ে যাবার সময়ে তা বাতিল আদেশ দিয়ে সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।

জানা যায়, আবেদনকারীরা একই জায়গায় বন্দর হতে জাহাজ নোঙ্গর করার জেটি অনুমোদন এবং বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বি.এফ.ডি.সি) হতে ৫ শতক জমি লিজ অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে মূল মালিকের আসা যাওয়া কম থাকায় ঐ সম্পত্তির উপর নজর পড়ে স্থানীয় কিছু ভূমিদস্যুদের। ভূমিদস্যুরা কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে রাতারাতি বদল করে নেন ঐ জায়গার মূল খতিয়ান। যা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দৃশ্যমান রয়েছে। অফিসের লোকজন বলেছেন এ খতিয়ান অনলাইনে ইনপুট করেছেন শাহেদ নামে এক অপারেটর।

অনুসন্ধানে খতিয়ানের অনলাইন আদেশ কপিতে দেখা যায়, চলতি বছরের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারী সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শিরীন আক্তার আদেশ করেছিলেন ২২শে মে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা উজ্জ্বল কান্তি দাশকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে। কিন্তু ১৬ মে শুনানিতে দেখা যায়, উজ্জ্বল কান্তি দাশ একদিনের ব্যবধানে অর্থাৎ আদেশ প্রদানের ঠিক একদিন পর একই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রদান করেন।

প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন সরেজমিনে তদন্ত করেছেন। ঐ জমির ভূমি সার্ভে করেছেন। এমনকি নতুন খতিয়ান প্রাপ্ত আবেদনকারীরা দখলে জমি রয়েছে। অভিযোগকারীর দাবি, যা সম্পূর্ণ অসত্য। এমনকি খতিয়ান কর্তন করার সময় কোন রকম নোটিশ ও সরাসরি শুনানী করা হয়নি। কোন সার্ভেয়ার সরেজমিনে তদন্ত করেনি। শুনানীর নোটিশও ছিল শুধু কাগজ কলমে। বাস্তবে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এতে অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে বলে ভুক্তভোগীর দাবি।

তিনি আরো জানায়, অনলাইন আদেশের পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেখা যায় ২২ মে শুনানীর ধার্য্য তারিখ থাকা সত্ত্বেও এর ৬ দিন আগে আরেকটি শুনানীর তারিখ লিখে দেওয়া হয়েছে। অথচ ঐদিন ছিলো এসিল্যান্ড শিরীন আক্তারের বদলি জনিত শেষ কর্মদিবস ছিল। যেখানে বালামে দেখানো হয়েছে শুনানীতে বিবাদী অনুপস্থিত। এটাও কাল্পনিক।

ভূক্তভোগীদের কাছে এসব অনিয়ম দৃশ্যমান হলে বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরীর কাছ থেকে ওই সময়ের আদেশ কপির জন্য আবেদন করলে তিনি জানান, গত ১৬/০৫/২০২২ইং তারিখে খতিয়ান পরিবর্তনের আদেশ সাবেক উপজেলা কমিশনার (ভূমি) শিরীন আক্তার স্বাক্ষরিত কোন ম্যানুয়ান কপি মূল ফাইলে নাই। অথচ অনলাইনে রেকর্ড রয়েছে। অভিযোগকারী জানান, নাজির দেবাশীষ রুদ্র, সার্ভেয়ার মোঃ ইউনুস ও অফিস সহকারি মাহবুব আলম এরাই এসবে জড়িত।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগকারী মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মোটা অংকের টাকা লেনদেনের বিনিময়ে প্রকৃত মালিকের ৩৮৭ ও ৫০৩ খতিয়ান বাতিল করে নতুন করে চরলক্ষ্যা গ্রামের আবদুল শুক্কুরের নামে ৩৪৮০ নং খতিয়ান সৃজন চেষ্টা করছেন। এতে আমাদের ২০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমরা এ খতিয়ান বাতিলে উচ্চ আদালতে রিট করেছি। সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছি। কারণ ভুয়া প্রতিবেদন দিলেন তহশিলদাল, খতিয়ান সৃজন করলেন এসিল্যান্ড।’

জানা যায়, সাবেক উপজেলা কমিশনার (ভূমি) শিরীন আক্তার বদলি জনিত কারণে ঢাকায় ট্রেনিং এ রয়েছেন। সমস্ত ডকুমেন্ট এসিল্যান্ড শিরীন আক্তারের হোয়াটস অ্যাপসে প্রেরণ করে অভিযোগের বিষয়ে একাধিকবার জানতে চাইলেও তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।

এছাড়াও চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা উজ্জ্বল কান্তি দাশ, নাজির দেবাশীষ রুদ্র, সার্ভেয়ার মোঃ ইউনুস ও অফিস সহকারি মাহবুব আলম জানান, অভিযোগটি ভিত্তিহীন ও তাঁদের হয়রানী করার জন্য এমন অভিযোগ করেছেন। অনেকেই আবার বলেছেন এসব কাজ ভূমি সহকারি কর্মকর্তা, নাজির ও সার্ভেয়ার মিলে করেছেন।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী জানান, ‘এসব আমি কর্ণফুলী আসার আগের ঘটনা। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা সমীচীন নয়। তবে আবেদনকারী কিংবা ভুক্তভোগীরা সেবা পেতে চাইলে আপত্তি জানিয়ে মিছ মামলা দাখিল করতে পারেন। তখন সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান জানান, ‘গতকাল এ ধরনের একটি লিখিত অভিযোগ অফিসে জমা দিয়েছেন। বিষয়টি ব্যবস্থা গ্রহণে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

(জেজে/এসপি/আগস্ট ০৭, ২০২২)