পীযূষ সিকদার


আচার্য সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের প্রাণ পুরুষ। ১৮ আগস্ট ১৯৪৯ তাঁর ৭৩ তম জন্মতিথি। প্রয়াণ ১৪ জানুয়ারি ২০০৮। মৃত্যু যে জীবনের ছেদ টানতে পারে না নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তার প্রমাণ। এই দিনে তাঁকে ঘিরে নাটক, সেমিনার, কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ আরো নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে  আচার্য সেলিম আল দীনের জন্মতিথি পালন করা হয়। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে সেলিম আল দীনই বাংলা নাটকের একমাত্র প্রধান জন। তাঁর সৃষ্টি কর্মের মধ্যে তিনি চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। মৃত্যু যে বিভাজন এঁকে দেয়-এই বিভাজন ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে চির বহমান চির অমলিন চিরঞ্জীব হয়ে আছেন আচার্য সেলিম আল দীন। তিনি রবীন্দ্রোত্তর বাংলা নাটকের প্রাণ পুরুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নাটককে যে স্তরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন সেলিম আল দীন হেঁটেছেন তাঁরই উচ্চতায়Ñতবে আকাশস্পর্শী ভিন্নতায়। আর হয়ে উঠেছেন অনন্য। বাংলা নাটক হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় যেভাবে এগিয়েছে তার রুপ-রস-গন্ধ নিয়ে সেলিম আল দীন সেই পথেই হাঁটলেন। নির্মাণ করলেন বাংলা নাটকের শ্রুতিময়তার যে শক্তি তা কাজে লাগিয়ে লিখেছেন একের পর এক নাটক।

বাংলা নাটককে পাঠ্য সূচির বাইরে এনে সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্যসহযোগে অভিনয় করলেন। আবিষ্কার করলেন মধ্যযুগের বাংলা নাট্য। আঙ্গিকের সঙ্গে বর্তমানের সমন্বয় কখনো বর্ণনাত্বক অভিনয় রীতি কখনো কথানাট্য কখনোবা দ্বৈতদ্বৈতাবাদী শিল্পতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে লিখে যান একের পর এক নাটক। ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি, চাকা, মুনতাসীর, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, কিত্তনখোলা, হাত হদাই, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, প্রাচ্য, বনপাংশুল, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ও কেরামত মঙ্গল। তাছাড়া আছে পুত্র, অমৃত উপাখ্যান উপন্যাসসহ অসংখ্য রচনা।

আগস্ট এলেই ভেতরে ক্ষত ও একই সাথে আনন্দের অশ্রু বন্যা বহে যায়। ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় সেই সাথে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা। নিজেকে ভাবনার অতল গহবরে নিয়ে যায়। ভেতরে রক্ত ক্ষরণ হয়। আর ১৮ আগস্ট এলে আনন্দে বিহবল নাগিনী বাজে। ১৮ আগস্ট যে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের জন্মতিথি। শোকের মাস আগস্ট। এক পিতার জন্য শোক করি। আরেক পিতার জন্মতিথিতে ভেতরে আনন্দের বিওগল বাজে। মরণ অনেকের জীবনকে পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেয়। আবার কেউ কেউ নিজের কর্মের বাহারি রঙে বেঁচে থাকে কাল থেকে কালে। জীবনের ইতি টানলেও জীবনতরী বেঁচে থাকে কর্মযজ্ঞে। চিরঞ্জীব হয়ে। নদী একদিন তার গতিপথ পাল্টায়, একসময় নদীও বিলীন হয়। কিন্তু সেলিম আল দীনের কর্মযজ্ঞে তিনি হয়ে আছেন চির অমলিন। বাংলা ও বাঙালি যতদিন আছে ততদিন সেলিম আল দীন জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকবেন। কাল থেকে মহাকালে। বাংলা নাটককে তিনি বিশ্বের দরবারে অধিষ্ঠিত করেছেন। ঔপনিবেশিকতার আগল থেকে বাংলা নাটককে মুক্ত করেছেন। বাংলা নাটক কালের সিঁড়ি বেয়ে স্বমহিমায় প্রজ্জ্বল হলো। তাঁর হাত দিয়ে।

আগস্ট এলেই শোকে মুহ্যমান হই। ১৮ আগস্ট এলে আবার প্রাণ ফিরে পাই। আমার পিতার জন্মতিথি! আমি নিজ পিতাকে দেখিনি! মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীরা ধরে নিয়ে যায়। পিতা ফিরে আসবে এমন ভাবনায় যখন মুহ্যমান! না পিতা ফিরে আসে না। খুঁজতে থাকি পিতাকে আকাশে বাতাসে...। ঠিক এমনই এক সময়ে আচার্য সেলিম আল দীন অত্যন্ত দরদ ভরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি নিলেন। ৭১-এ হারানো পিতাকে ফিরে পেলাম। তাঁর নাম আচার্য সেলিম আল দীন। তাঁকে পিতাজ্ঞানে পূজা করি। উঁনি নেই কে বলেছে! এই তো আমার পড়ার টেবিলে বসে আছেন। যে দিকে তাকাই সে দিকেই পিতাময়। আজ আমার আনন্দের দিন। আজ আমার কুড়িয়ে পাওয়া পিতার জন্মদিন। এতদিনের শোক নিমিষেই ভুলে যাই। আজ আমার পিতার জন্মদিন। ১৫ আগস্ট। ২১ আগস্ট। ভোলা যায় না! আমার পিতার চলে যাওয়া ভোলা যায় না! ১৪ জানুয়ারি ২০০৮ আমার আমার আরেক পিতার প্রয়াণ ভোলা যায় না।

আমরা এমনই এক জাতি অনবরত ভুলে যাই। মনে রাখি না কাউকেই! ভুলই আমাদের প্রায়শ্চিত্ত। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে সবই ভুলতে বসেছিলাম। যে মানুষটি গ্রাম থেকে টেনে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। তাকেও ভুলতে বসেছিলাম। তাঁর মৃত্যু আমাকে নতুন করে ভাবনার দুয়ার খুলে দিলো। পিতার জন্য চোখের জল ঝরতে থাকলো। সবার অগোচরে আমিই তাঁর পুত্র হয়ে উঠি! কেউ হয়তো ভ্রু বাঁকা করে ইংগিতপূর্ণ কথা বলবে! বলুক তাতে আমার কী এসে যায়! আমিই তাঁর একমাত্র পুত্র। আজ আচার্য সেলিম আল দীনের ৭৩ তম জন্মতিথি। জন্মের ক্ষণে আমিও কি ছিলাম ধূলোমাটি হয়ে? নইলে পিতা ডাকি কেন!

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের হাত বেয়ে অসংখ্য নাটক রচিত হয়েছে। প্রায় সব নাটকেই ভাঙা মানুষ স্থান পেয়েছে তাঁর নাটকে। তাঁর নাটকে ইউরোপীয় নাটকের মতো দ্বন্দ্ব নেই! নাটক চলে কথার পীঠে কথা সাজিয়ে। তাঁর নাটকে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রোটোগনিস্ট চরিত্র নেই। দ্বন্দ্ব আছে তবে সে দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি হয়ে যায় চরিত্রের কথার বাকপটুকতায়।

আচার্য সেলিম আল দীন একটি অধ্যায়। একটি শুভসূচনার নাম। যে অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো-স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক ধূম্রজালে মানুষ যখন আক্রান্ত; রক্ত, অস্থিরতা, ধর্মীয় লেবাস যখন হয়ে উঠে মুখোশ;আসল যখন নকলের ভিড়ে তার মৌলিকতা হারায়, তখনই নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন নাটককেই তার যুদ্ধের হাতিয়ার করে নেন। মনোনিবেশ করেন বাংলার নিজস্ব শিল্পযাত্রায়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, ধরলার কূলে কূলে নামহীন-গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবন তাঁর নাটকে উঠে এসেছে বারবার। সেলিম আল দীন বাংলার হাজার বছরের লালিত নাট্যরীতি ও শিল্পরীতির স্ব-ভূগোলে হেঁটেছেন। দীর্ঘ গবেষণার পর বাংলা বর্ণনাত্বক নাট্যরীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে রচনা করেছেন গবেষণা গ্রন্থ ‘‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’’। স্ব-ভূগোলে শিকড় মেলে নিজের দেশ-কাল, শিল্পরুচি এবং নিজের শিল্পতত্ত্বকে বিশ্বভূগোলে দাঁড় করিয়েছেন আচার্য সেলিম আল দীন। তিনি শিল্পের কোনো ভেদ মানতেন না। অভেদাত্মার বেদমন্ত্রই শুনি তাঁর শিল্পসৃজনে।

আচার্য সেলিম আল দীন আর তো ফিরে আসবেন না কোনোদিন! কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট! তাঁর মৃত্যু আমাদের সাথে ছেদরেখা টানলেও তাঁর কর্মের মহিমায় চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। এখানেই আমাদের আনন্দ। এই তো স্যার আছেন সারি সারি বইয়ের ভেতর। উত্তরে তাকালেই স্যার তাকিয়ে আছেন। বলে পীযূষ কিছু তো করতে পারলি না! আমি চমক ভেঙে উঠি। তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে পথ চলি। তিনি বলেন, কিছু তো করতে পারলি না! সব সময় আমার কথার বাইরে গেছিস! পিতা যে আপনি! এভাবে কথা বলে বলে সময় পার। এখনো চর্যাপদে তাঁর সাথে কথা বলে বলে বাংলা নাটককে বুঝবার চেষ্টা করি। আমার মতো লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র তাকে আর কতটুকুনইবা চিন্তে পারি! পিতা, আজ তোমার জন্মতিথি। জন্মের শুভক্ষণেই ধুলোমাটি গায়ে প্রতিবার নিজেকেই আবিষ্কার করি তোমার সৃষ্টি সম্ভারে! পিতা, তোমার মৃত্যু নেই! তুমি যে চিরঞ্জীব। তোমার মধ্যে বারবার নিজেকেই খুঁজে ফিরি! জন্মতিথি শুভ হোক।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।