আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহে গত ২১ জুলাই যখন শপথ নেন, তখন রাজধানী কলম্বোর দশা ছিল অনেকটাই সুনসান। জ্বালানির অভাবে বেশিরভাগ গাড়ি রাস্তায় নামেনি অথবা একপাশে দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তেলের জন্য। প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের বাইরে ছিল নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া পাহারা আর শক্ত ব্যারিকেড। সাধারণ মানুষ ঘরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছিল বিদ্যুতের জন্য। এগুলো অবশ্যই একটি সংকটে পড়া দেশের দৃশ্য।

কিন্তু এর মাত্র সপ্তাহ তিনেক পরেই শহরটিকে আজ ভিন্ন জায়গা মনে হয়। জ্বালানির জন্য দীর্ঘলাইন গায়েব হয়েছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার শব্দ ফিরেছে। সৈকতে ফিরেছে কাঁকড়া আর কাসাভা চিপস বিক্রেতা ফেরিওয়ালারা। হাসিখুশি পরিবারগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনের আনন্দে চিপস খাওয়াচ্ছে বাচ্চাদের। বিক্ষোভকারীরা চলে গেছে, কাউকে জোরপূর্বক সরানো হয়েছে, বাকিরা গেছে নিজেদের ইচ্ছাতেই। নিরাপত্তা প্রহরাও শিথিল হয়েছে অনেকটা। যদিও লোডশেডিং এখনো চলছে, তবে তার সময় কমে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার একটি অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।

রনিল বিক্রমাসিংহেকেও এখন তুলনামূলক নিরুদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় এসব পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছে মূলত দুটি বিষয়। প্রথমত, বহু শ্রীলঙ্কান বিশৃঙ্খলায় ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং আইনের শাসন চাচ্ছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক পতনের কারিগর গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন সরকারকে সব কিছু ঠিক করার একটি সুযোগ দিচ্ছে চেয়েছিলেন তারা।

দ্বিতীয়ত, বিক্রমাসিংহে সব দল ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সবার কাছে যাচ্ছিলাম। এমনকি রাজাপাকসেকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অবদান রাখা বিক্ষোভকারীদের কাছেও। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পার্লামেন্টে নিজের প্রথম ভাষণেই বিক্রমাসিংহে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে মতামত চাওয়ার জন্য একটি ‘জনতার পরিষদ’ গড়ার ঘোষণা দেন এবং আন্দোলনকারীসহ তরুণদের অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান।

নতুন প্রেসিডেন্টের প্রথম কাজ ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো। জুলাই মাসের বিশৃঙ্খলায় সেটি পিছিয়ে গেলেও বিক্রমাসিংহে আশাবাদী, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই একটি প্রাথমিক চুক্তি হয়ে যাবে। এতে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং অন্য ঋণদাতাদের সঙ্গে সমঝোতা করাও সহজ হয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি।

অন্যতম বৃহত্তম সহযোগী চীন সম্প্রতি জাম্বিয়ার কিছু ঋণ মওকুফ করে দিতে রাজি হয়েছে। ফলে অন্য ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রেও তারা একই নমনীয়তা দেখাতে পারে বলে আশা তৈরি হয়েছে। অবশ্য জাম্বিয়া একটি নিম্নআয়ের দেশ। আর ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক সংকটের পরেও শ্রীলঙ্কা এখনো মধ্যম আয়ের। সুতরাং দুই দেশের ক্ষেত্রে একই নীতি খাটতে না-ও পারে বলে মনে করেন বিক্রমাসিংহে।

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট সংস্কারের বন্যা বইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আয়কর বাড়িয়ে ২০১৯ সালের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। করের ভিত্তি সংকটের আগে যে অবস্থায় ছিল, তার চেয়েও বিস্তৃত করতে চান বিক্রমাসিংহে। এয়ারলাইন, পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং টেলিকম খাতে সরকারের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের চ্যাপ্টার ১১-এর আদলে শ্রীলঙ্কায় একটি দেউলিয়া আইনও পাস করতে চান লঙ্কান প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলেন, আমার মতে, কাটলে গভীর করে কাটুন। কোনো কিছু পরিবর্তন করার সময় তা গভীরভাবে করুন। যত পরিবর্তন দরকার সব আনুন। বিক্রমাসিংহের আশা, এগুলো শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে কেবল পুনরুদ্ধারই নয়, বরং আরও প্রতিযোগিতামূলক ও রপ্তানিমুখী করে তুলবে। তিনি চান, এশিয়ার বাকি দেশগুলোর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বাড়ুক। লঙ্কান প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা আসিয়ান এবং আরসিইপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে নজর দিয়েছি।

তবে এসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সেগুলো পার্লামেন্টে পাস করানোর কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে বিক্রমাসিংহকে। তিনি একটি সর্বদলীয় সরকার গড়ার চেষ্টা করছেন, যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সমস্যা না হয়। তবে সেই পথে সামান্যই এগিয়েছেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট। শ্রীলঙ্কার অনেক আইনপ্রণেতারই নজর এখন পরবর্তী নির্বাচনের দিকে। তাছাড়া বরাদ্দ কমানো এবং কর বাড়ানোর দায়ভার কাঁধে নিতেও খুব একটা আগ্রহী নন তারা। শোনা যায়, গোতাবায়ার ভাই ও শ্রীলঙ্কার সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে এরই মধ্যে তাদের পরিবারের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের ছক আঁকতে শুরু করেছেন।

রনিল বিক্রমাসিংহে হয়তো বাস্তবের চেয়েও এগিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তিনি ২০৪৮ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে একটি উচ্চ-আয়ের দেশে এবং দ্বীপটি রাষ্ট্রটিকে নতুন সিঙ্গাপুরে পরিণত করার কল্পনাপ্রসূত কথা বলেছেন। এমনকি যাকে আরও অর্জনযোগ্য লক্ষ্য হিসেবে দাবি করেছেন, তাও বেশ উচ্চাভিলাষী। লঙ্কান প্রেসিডেন্টের কথা, আসুন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মান দিয়ে শুরু করা যাক। প্রকৃতপক্ষে, কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কা যে অবস্থানে ছিল, আপাতত সেখানে ফিরে যেতে পারলেই খুশি হবেন অনেক শ্রীলঙ্কান।

(ওএস/এসপি/আগস্ট ১৭, ২০২২)