নাজনীন সাথী


সোনাপুর গ্রামের চান্দের হাট। মাত্র কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে হাট ছিল কেনাবেচার একমাত্র সরগরম স্থান। সরগরম কথাটা এখানে এজন্য আসছে কারণ বাজার দোকানপাটে লোক সমাগম ও বেচাকেনার দিক থেকে সেসবের দশা ছিল জীর্ণপ্রায়। সপ্তাহান্তে হাটবারের দুইদিন নানা পণ্য নিয়ে লোকজন হাটে আসতো দূরদূরান্ত থেকে। কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতো। তাই তখনকার বাজার ব্যবস্থায় হাটই ছিল উচ্চকিত স্থান।

এখন চারিদিকে বিশ্বায়নের জয়জয়াকার। আমাদের হাতের নাগালে সবর্ত্র বাজার অর্থনীতির মোচ্ছব। বাটনে আঙুল ছোঁয়ালেই পণ্য এসে হাজির হাতের নাগালের মধ্যে। কর্পোরেট দুনিয়াতে নাট্যকার পীযূষ সিকদার চান্দের হাটের কথা বলছেন। ইউরো ডলার পেরিয়ে রিয়েল টাকার সঙ্গে মোবাইল ফোনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছেন সোনাপুর গ্রামের হাটের কথকথা।

এদেশের অসংখ্য নদনদী হাওর-বাওর বেষ্টিত জনপদের প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে আছে নানা কল্পকাহিনী। পলিঘেরা বদ্বীপের অধিবাসীদের মন বংশ পরম্পরায় নানাধরনের সুর ও সঙ্গীতের ছোঁয়ায় স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। নাট্যকারের দৃষ্টি আমাদের দেখাতে নিয়ে যায় চারটি গ্রাম ও একটি নদের পারের সোনাপুর গ্রামের চান্দের হাটকে। সেখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার শচীন্দ্র বাবু। নিজের জমিদারীতে তিনি এই হাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দূর দূরান্ত থেকে বণিকদের নিয়ে এসে চান্দের হাট আস্তে আস্তে জমিয়ে তুলেছিলেন। সেসব শত বছর আগে গত হওয়া ইতিহাস। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে রাজা জমিদাররা। তাদের দোর্দ- প্রতাপের ভূমিতে ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ফাঁকফোকর গলে রাজত্ব করে আজকের কোরবান ফকিররা। কোরবানের জন্ম হয়েছিলো ফকির বংশে কিন্তু সে ফকরামি ছেড়ে দিয়ে পাড়ি জমায় মরুর দেশে। ধুসর মরুভূমি তাকে টাকার সন্ধান দেয়। সে এখন অনেক অনেক টাকার মালিক। গ্রামে ফিরে আসে কুরবান তাঁর স্ত্রী পরিবারের জন্য ঝাঁকা ভরে বাজার করে আনে চান্দের হাট থেকে। সোনাপুর গ্রামের কোরবান ফকির। কুয়েত ফেরত কুরবান ফকির। অনেক টাকার মালিক হয়েও স্বভাব পাল্টাতে পারে না। তাই ঝাঁকাভরা বাজার চান্দের হাট থেকে ভ্যানে করে না এনে মাথায় করে নিয়ে আসে সোজা তার দোতলা বড়িতে। পেশাগতভাবে ফকিরগিরি ছেড়ে দিলেও কোরবানের মগজের গহীনে খেলা করে গভীর ভাব। বৈশাবী নদের তীরে দাঁড়িয়ে আলো আধাঁরির মাঝে শত শত মানুষের সঙ্গে কোরবান ফকির দেখতে পায়-হঠাৎ নৌকায় কে যেন আসে! অন্ধকারে বোঝা যায়। নৌকা নদীর ঘাটে থামে। দিঘল দেহ। পাট করা চুল পরনে। আলো আঁধারির ইন্দ্রজাল কেটে গিয়ে কোরবান মুখোমুখি হয় জ্বলন্ত বাস্তবের-একপাশে পড়ে থাকে স্ত্রী কুলসুম চান্দের হাট সোনাপুর গ্রাম বৈশাবী নদ; অন্যদিকে পূবপার্শ্বে খানিকটা দূরে ধান গম আটা মাছ সবজি নয় অন্যকিছু বেচাঁকেনা হয়। এখানে বেচাঁ-কেনা হয় শরীর, কেউবা দুধ বেচেঁ কেউবা দুধ বেঁচে গাজা খায়!

চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণের কীর্তন আলাউল থেকে মনসামঙ্গল সবকিছুকে অতিক্রম করে এদেশে আসে ইংরেজ বণিকেরা। বাণিজ্যের সাথে তারা নিয়ে আসে নিজ দেশের সাংস্কৃতিক নীতি। দুইশো বছরের শাসনকালে এই জনপদের উপরে তাদের সংস্কৃতির মোটা প্রলেপ দেয় তারা। তবে আবার কেন সেই কথনরীতি যা আমাদের বাংলার সংস্কৃতির শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেবে? ঔপনিবেশিক বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছে এদেশের নাটকের দিকপালেরা তাদের মধ্যে সেলিম আল দীন অন্যতম। নাট্যকার পীযূষ সিকদার তাঁর গুরুর দেখানো পথে হেঁটে কি শেকড়ের সন্ধান করতে চেয়েছেন? তাঁর আগামী পথচলায় আমরা তারই সন্ধান করবো। নাট্যকারের জন্য শুভকামনা।

লেখক : কবি ও গল্পকার।