মৌমিতা রানী সান্যাল


একাত্তরের কথা বলতে আমরা বুঝি ১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা। আমার শ্বশুর মহাশয় দেবেশ চন্দ্র সান্যাল মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অসম সাহসী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর জন্মস্থান গ্রাম ও ডাকঘর-রতন কান্দি, ইউনিয়ন- হাবিবুল্লাহ নগর, উপজেলা- শাহজাদপুর, জেলা- সিরাজগঞ্জ। বর্তমানে আমরা পরিবারের সবাই উল্লাপাড়া উপজেলার ঘোষগাঁতী মহল্লায় বসবাস করি। তাঁর কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী প্রত্যয়ন করেছেন। রনাঙ্গনে তিনি ছিলেন দু:সাহসী। তাঁর কোনো মৃত্যু ভয় ছিল না। প্রত্যেকটি যুদ্ধে তিনি ক্রোলিং করে সম্মুখ ভাগে গিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাহাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। প্রত্যেকটি যুদ্ধে তাঁর দল বিজয়ী হয়েছে। আমরা সবাই তাঁর জন্য গর্ব বোধ করি।

একদিন তাঁকে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কথা জিঞ্জেস করলে তিনি বলেন, ‘২৫ র্মাচ ১৯৭১’ মধ্যরাতে পূর্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা (অপারেশন সার্চ লাইট) নাম করন করে অতর্কিত বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।তারা বাঙালিদের নির্যাতন, জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা ও গণ হত্যা শুরু করলো। তারা ভারি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বাঙালিদেরকে গুলি করে পাখির মত হত্যা করল। পাকিস্তানি হানাদারেরা আমাদের উপর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দিল। বাধ্য হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৩২নম্বর ধানমন্ডির বাসায় উপস্থিত সকলের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানি হানাদারেরা ২৩ এপ্রিল’৭১ আমাদের এলাকার বাঘাবাড়ি ঘাট দক্ষিণ পাড় এলো। বাঘাবাড়ি ঘাট দক্ষিণ পারে এসে এলাকায় ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এক শক্তিশালী মর্টার শেল ছাড়লো। মর্টার শেলের আক্রমনে সব এলাকা কেপে উঠলো। মানুষ জন যার যার মত আত্ম রক্ষার জন্য ছুটাছুটি করতে থাকলো। বাঘাবাড়ি ঘাটের উত্তর পাশে প্রতিরোধ যুদ্ধ করার জন্য বাঙালিসৈন্য ই.পি.আর আনসার ও অন্যান্য রা বাংকার করে পজিশন অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের ভারী অস্ত্রের কাছে টেকা সম্ভব হবে না বিবেচনায় প্রতিরোধ কারীরা পজিশন ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন।

২৫ এপ্রিল আমাদের পার্শ্ববতী উল্লাপাড়ার চড়িয়া শিকার নামক গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্য এদেশের পাকিস্তান সমর্থক কিছু মানুষকে দিয়ে রাস্তা ও অন্যান্য চিনিয়ে নিয়ে সাথে রেখে গণ হত্যা করলো। ২৭ এপ্রিল এই গণ হত্যায় ১২৯ জন হিন্দু-মুসলমান নারী,পুরুষ ও শিশুকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। জানতে পারলাম ওরা হিন্দুদের প্রতি বেশী ক্ষ্যাপা। যে কোন পুরুষকে আটক করলে হত্যা করার আগে হিন্দু-মুসলমান পরীক্ষা করার জন্য বলতো “কাপড়া তোল, চার কলেমা বাতাও”। আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদেরকে ওরা ভারতের দালাল বলতো। বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিত। বাঘা বাড়ি ঘাট পাড় হয়ে আমাদের শাহজাদপুর উপজেলা সদরে (তৎকালীন থানা সদর) অবস্থান নিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা আদেশ দিয়ে পাকিস্তান সমর্থক মুসলমান যুবকদের দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও হিন্দুদের বাড়ি ঘর,দোকান-পাট লুটরাজ করালো।

বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। ১৪ মে’৭১ ফরিদপুর থানার ডেমরা ও সাঁথিয়া থানার রূপসী বাউস গাড়ী গ্রামে গণহত্যা করলো। এই গণ হত্যায় আমার সাত জন নিকট আত্মীয় সহ সাত শতাধিক নারী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলমান কে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলো। সারা দেশে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের এদেশীয় দোসর দের সাথে নিয়ে হত্যা,গণহত্যা, জ¦ালাও, পোড়াও, নারী ধর্ষণ নিপিড়ন প্রভৃতি মানবতা বিরোধী কাজ করতে লাগলো। আমি ঢাকা ও অন্যান্য শহরে চাকুরি করা প্রত্যক্ষদর্শী ও আমাদের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড. জনাব মো: আব্দুর রহমান এর কাছ থেকে সব শুনতে ও জানতে পারলাম। আমি শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম জাতির এই ক্রান্তি কালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবো। তখন আমার মুক্তিযুদ্ধ কী? ভয়ানক এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হতে পারবো কিনা ইত্যাদি বুঝে উঠার বয়স হয়েছিল না।

২৩ জুলাই’৭১ রাতে আমি এম.পি.এ জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমরা এক সাথে ২২ জন রওনা হলাম। যাবার সময়ে বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাইনি। আমরা সুজানগর সাত বাড়িয়া হয়ে পদ্মা নদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চিলমারি ইউনিয়নের খারিজাথাক গ্রাম দিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের বর্ডার অতিক্রম করলাম। আমরা ভারতের পশ্চিম বাংলার জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলাম। এম.পি.এ স্যার আমাদে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষনের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের উদ্দেশ্যে কলিকাতা চলে গেলেন। আমি প্রথমে ভর্তি হলাম কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়সের স্বল্পতার কারণে প্রথম ট্রেনিং কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে চাইলেন না। কয় এক দিন ভারতে বিভিন্ন স্থানে ঘুরলাম। আবার ফিরে এলাম কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে।

আমাকে ভর্তি করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করলাম। কর্তৃপক্ষ আমার একটা ইন্টার ভিউ নিলেন। আমার দেশ প্রেম, সাহসী মনোভাব ও অন্যান্য শুনে ভর্র্তি করলেন। প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে শুধু আমাদের ফলইং করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হত আর পিটি প্যারেড করানো হত। কদিন কামারপাড়া থাকার পর আমাকে ও রবীন্দ্র নাথ বাগচী, রতন কুমার দাস ও মো: নজরুল ইসলাম কে ট্রান্সফার করলো মালঞ্চ ক্যাম্পে, তারপর মালঞ্চ থেকে কুড়মাইল ক্যাম্পে। সেখানে থেকে আমাদের কে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে এক যোগে ভারতীয় আর্মি লরিতে ২০/২২ জন কে নিয়ে আসা হলো দাজিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে। এই ট্রেনিং ক্যাম্প টি ছিল ভারতের শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক স্থানে। পানিঘাটা স্থান টি ছিল চারি দিকে পাহাড়ের মধ্যে। কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শে¦র বনাঞ্চল। ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের তাবুর মধ্যে থাকার সিট করে দিল। আমাদের প্রত্যেক কে একটা মগ, একটা প্লেট দেওয়া হলো।

ট্রেনিং শুরু হলো। আমাদের ২১ দিনের ট্রেনিং হলো। আমাদের কে থ্রিনট থ্রি রাইফেল এস,এল,আর ষ্টেনগান, ২ মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ, এক্সপ্লোসিভ ও ফাষ্ট এইড সহ অন্যান্য ট্রেনিং দিল। যুদ্ধে সহযোদ্ধা আহত হলে করণীয় সর্ম্পকে ফাষ্ট এইড সম্পর্কে ধারণা দিল। ভারতীয় কয়েক জন হিন্দু বিহারী ও শিখ সৈন্য প্রশিক্ষন দিল। প্রধান প্রশিক্ষক ডি.এস. ভিলন স্যার এর কাছ থেকে জানলাম আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২। ট্রেনিং শেষে আমাকে রবীন্দ্র নাথ বাগচী, মো: নজরুল ইসলাম ও রতন কুমার দাসকে নিয়ে আসা হলো ৭ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তরঙ্গপুরে। তরঙ্গপুর এনে সিরাজগঞ্জ জেলার ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ করা হলো। আমাদের গ্রুপের গ্রুপ লিডার হলেন বেলুকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম.এ মান্নান, ডেপুটি লিডার হলেন বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমরা তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, রেশনিং ও পকেট মানি দেওয়া হলো।

মৃত্যু যে হবেনা এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না। তাই আমি তরঙ্গপুর বাজার থেকে একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, একটি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও একটি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। তরঙ্গপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসন ষ্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন বদলাতে হলো। আসাম গামী ট্রেনে উঠলাম। ভারতীয়রা আমাদেকে জয় বাংলার লোক বলতো। সরকারি বাস ও ট্রেনে টিকেট চাইতে এলে “জয় বাংলা” বললেই আর টিকেট বা ভাড়া চাইতো না। আসাম গামী ট্রেনে ধুবরী নামক ষ্টেশনে আমরা নামলাম। বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে যাবার কারণে রাতে মানিকার চর একটা বডিং এ থাকলাম। পরদিন সকালে নদী পার হয়ে এলাম তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রৌমারী ক্যাম্পে আমরা ¯œান খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তাঞ্চল যমুনার চড়ে পৌছানোর জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। রৌমারী ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯:০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। ইহা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর’৭১।

নৌকা বাহাদূরাবাদ ঘাটের সম্মূখ দিয়ে আসতে হয়। আমরা জানতে পেরে ছিলাম। বাহাদূরাবাদ ঘাট অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঐ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ভয়ানক। তারা স্পীড বোর্ড নিয়ে রাতে নদী টইল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমাদের কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হায়েনারা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহীদ হবো কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না। রাত ২.০০ টার দিকে আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ওদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকাতে পড়ছিল। ভগবানের কৃপায়-ওরা আর স্পীড বোট নিয়ে ধরতে এলোনা। আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়া গুড় ছিল। ভোরে এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ডুকিয়ে দিয়ে প্রাত:ক্রিয়া করলাম। তার পর নৌকা ছাড়লো।

তখন কাজিপুর থানার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। কাজিপুর থানার সম্মুখ দিয়ে আমাদের নৌকা আসবে। দেখে শুনে থামিয়ে থামিয়ে ৪ দিন ভরে নৌকা এসে পৌছালো সিরাজগঞ্জ হানাদর মুক্তাহঞ্চল চরে। ইহা ছিল টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির কাছাকাছি। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা কোন রকমে রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। এই ভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছিলাম। একদিন রাতে যমুনা নদীর এপাড়ে চলে এলাম। চলে এলাম বেলকুচি-কামারখন্দ নির্বাচনী এলাকার এম.এন.এ জনাব মো: আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। অক্টোবর’৭১ মাসের মাঝা মাঝির আগ পযর্ন্ত আমাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধ সংখ্যা কম থাকায় সম্মূখ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কমান্ডার নেন নি। আমরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের দোসরদের আতঙ্কে রাখার জন্য গেরিলা কার্যক্রম হিট এন্ড রান চালাতাম।

ক্যাম্পের নিকট বর্তী গিয়ে ২/৪ টা থ্রি নট থ্র্রি রাইফেলের আকাশ মুখি গুলি ছুড়ে চলে আসতাম। পাকিস্তানি দালাল, পীচ কমিটির লোক ও অন্যান্যরা আমাদের অস্তিস্তের কথা জানতে পারতো। আমরা দিনের বেলা স্কুলে বা কারো বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। পালা ক্রমে দু’জন করে করে নিজেদের কে পাহাড়া দিতাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের পাশ ওর্য়াড দিতেন। আমরা রাতে বিভিন্ন রাজাকারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বুঝাতাম। সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম ও পরিস্কার করতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। তবুও আমাদের কে সহজ সরল মানুষ গুলো শেল্টার বা খাবার দিতে চাইতেন না। কারণ অধিকাংশ গ্রামেই ছিল পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার। তারা খোঁজ জানলে পার্শ্ববর্তী আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্পে সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিবে, বাড়ির মালিকতে হত্যা করবে ও অত্যাচার চালাবে এই ছিল তাদের ভয়।

আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা-কমীদের ট্রেনিং দেওয়ায়ে আমাদের সাথে নিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে আমার পিতৃদেব ও মাতৃদেবী পাগল প্রায় হয়ে গিয়ে ছিলেন। আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য গোটা পরিবার ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ভারতের আসামের মানিকার চড় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। আমাদের গ্রুপের অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আরো প্রয়োজন হওয়ায়। কামান্ডার স্যার তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আনার জন্য সিরাজগঞ্জের এম.এন,এ এর ভায়রা বাঐল গ্রামের মো: আব্দুল হামিদ তালুকদার কে পাঠানো হলো। মো:আব্দুল হামিদ তালুকদারের কাছে আমি আমার পিতৃদেব মাতৃদেবী ও পরিবারের অন্যান্য পরিচয় লিখে দিলাম। তিনি মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আমার বাবা মা ও অন্যান্যদের সাথে দেখা করলেন। আমার পিতা-মাতা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মো: আব্দুল হামিদ তালুকদারের সাথে পাঠিয়ে দিলেন মেজ দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল কে।

তিনি ৬ নভেম্বর’৭১ দৌলতপুর গ্রামে মো: শামসুল হক এর বাড়িতে এসে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী কে বললেন “আমার ভাই দেবেশের জন্য বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। ভাইকে ফিরিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী আমার মেজ দাদা কে বললেন-“আপানিও আমাদের সাথে থাকুন আপনাকে আমরা ট্রেনিং দেওয়ায়ে মুক্তিযুদ্ধে করার উপযুক্ত করে দিব। এখন ভারতে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ দেবেশের নামে অস্ত্র ইস্যু করা আছে। অল্প দিনের মধ্যে দেশ স¦াধীন হবে। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর কথা মেজদা মেনে নিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী ও অন্যান্যদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিলেন। অক্টোবর’৭১ এর শেষ দিক থেকে আমরা আক্রমন সন্মুখ যুদ্ধ করা শুরু করলাম। আমরা রেকী করে দেখতাম। তারপর আক্রমন করতাম। আমরা ১, বেলকুচি থানা আক্রমন যুদ্ধ ২, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহন করা ট্রেন ধংস করার পরিকল্পনা ৩, কল্যানপুর যুদ্ধ ও ৪, শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। আমাদের প্রত্যেকটি যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ।একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ।

আমরা ‘জয় বাংলা’ জয় বঙ্গবন্ধু বলে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের হত্যা করেছে। কিন্তু আমাদের গ্রুপে আমরা কাউকে হত্যা করি নাই। সবাই কে বুঝিয়ে স্বাধীনতা পক্ষে এনেছি। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে ২জন রাজাকার কে জ্যান্ত ধরে এনেছিলাম। কিছু সময় চোখ বেধে আমাদের শেল্টারে রেখে ছিলাম। তাদের কে বুঝিয়ে স্বাীধনতার পক্ষে এনে রাত্রিতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় ছেরে দিয়ে ছিলাম। আমরা সকল যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। যুদ্ধ জয়ের পর ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার আমাদের সকল অস্ত্র সিরাজগঞ্জ ইব্রাহিম বিহারী বাসায় অস্ত্র জমা নেওয়া ক্যাম্পে জমা দিয়ে দুই সহোদয় বাড়িতে চলে আসি”। তাঁর পর আমার শ^সুর মহাশয় রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল এর কাছ থেকে অষ্টম শ্রেনীর অটোপাসের টিসি নিয়ে শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শুরু করেন’’। আমার শ্বশুর মহাশয় দিনে দিনে লেখা-পড়া শেষ করে। ঢাকা বিশ^ বিদ্যালয়ে মাকেটিং বিভাগে এম.কম. ভর্তি হন। তিনি ১৯৮০ সালে সোনালী ব্যাংকের চাকরিতে যোগাদান করেন। আটত্রিশ বছরাধিক সোনালী ব্যাংক লিমিটেডে চাকুরি করে গত ২৬/০৯/২০১৯ ইং তারিখে এস.পি.ও হিসেবে অবসর গ্রহণ করে বর্তমানে আমাদের সাথে অবসর জীবন যাপন করছেন। 

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধার পুত্র বধুমাতা, গৃহিণী ও ছাত্রী।