শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : পাখির অবিরাম কিচিরমিচির শব্দ আর কলকাকলিতে মুখরিত থাকে এখন দিনাজপুরের কয়েকটি গ্রাম। প্রকৃতির অপরূপ মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য দেখার জন্যে এলাকাগুলোতে এখন ছুঁটে আসছেন, প্রকৃতি ও পাখি প্রেমিরা। গ্রামের মানুষের ভালবাসা আর নিরাপত্তা পেয়ে বংশ বিস্তাারের মাধ্যমে দিনদিন বাড়ছে এই পাখির সংখ্যা। পাখিগুলো সংরক্ষণে প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমী সচেতনতা সৃষ্টিতে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। গ্রামবাসীরাও অপার মমত্বে আগলে রাখেছেন এই পাখিগুলোকে।  

দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভাবকী ইউনিয়নের মাড়গাঁও গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়ির আশপাশ এলাকার বাঁশঝাড়, গাছ-গাছালিতে এখন হরেক রকম পাখির স্থায়ী আবাসস্থল। সদর উপজেলার নিভৃত পল্লী ভাটিনা, শহরের বালুবাড়ী খাদ্য অধিদপ্তর ও তার আশপাশ এলাকা, ইকবাল হাইস্কুল চত্বর, সদর উপজেলার ভাটিনায় প্রকৃতির অপরূপ খেয়ালে বাসা বেঁধে আছে এখনো অসংখ্য বক, শামুক খৈল, এশিয়ান ওপেন বিল, ওপেন বিল ষ্টক ও হাইতোলামদন টাক, শামুক ভাঙ্গা পাখি। সন্ধার আগে এসব পাখি ফিরে আসে আবাসস্থলে। বংশ বিস্তারের পাশাপাশি পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর কলকাকলিতে মুখর থাকে এলাকাগুলো। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে এলাকাবাসীর। মনোমুগ্ধকর এমন দৃশ্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুঁটে আসেন, প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমিরাও।

এলাকাবাসী জানায়, খানসামায় পাখির নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলেন পাখিপ্রেমি মরহুম সফিউদ্দিন মন্ডল শাহ্,হযরত আলী শাহ্ ও ভাবকী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম নজরুল হক শাহ্। অন্তত দেড়’শ বছর ধরে পাখিরা এখানে নিরাপদে বসবাস শুরু করে। বিভিন্ন প্রন্ত থেকে সারাবছর পাখিদের আসা-যাওয়া এ চেয়ারম্যান বাড়িতে। বাড়ির চারপাশে অন্তত অর্ধ-শতাধিক বিঘা জমির ওপর সবুজ ছায়াঘেরা হাজারো গাছ ও বাঁশঝাড়ে পাখিরা অভয়ারণ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। এখানে সারাবছরই দেখা মেলে বিলুপ্ত প্রায় কালো পানকৌঁড়ি, সারস, সাদা-বক, জ্যাঠা-বক, আম-বক, কানি-বক, ডাহুক, ঘুঘু, ডাউকী, বাদুড়, হারগিলা ও রাতচোরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। বাঁশ ও বিভিন্ন গাছের চূড়ায় বসে পাখির ডানা ঝাপটানোর অপূর্ব দৃশ্য হরহামেসাই চোখে পরে দর্শনার্থীদের। আবার গাছের মগডালের উপর দিয়ে দুই-এক চক্কর দিয়ে গাছের চূড়ায় বসছে। কোনটা গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে, আবার কোনটা বাঁশের এক কঞ্চি থেকে অন্য কঞ্চিতে উড়ে চলছে।

পাখিদের বাসার ভেতর থেকে ছানাগুলো টেক টেক শব্দ করছে। তাদের খাওয়াতে ব্যস্ত মা-পাখিরা। কোনোটি বাসা বাঁধছে আপন মনে, আবার কোনোটি ডিমে তা দিচ্ছে। নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না পাখির সঙ্গে মানুষের কতটা নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। গাছগুলোতে রঙ-বেরঙের পাখির ছোটাছুটি যে কারো মন কেড়ে নেয়। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় ইটপাথরের জীবনের কথা। এখানে সকাল-বিকাল হাজার হাজার পাখির দেখা মিলে। এসব পাখি আশপাশের বিল ও ক্ষেতে খাবার খেয়ে ও সংগ্রহ শেষে চেয়ারম্যানবাড়ির গাছ ও বাঁশঝাড়গুলোতে আশ্রয় নেয়। শুধু তাই নয়-এ চেয়ারম্যান বাড়িতে বন্যপ্রাণির মধ্যে রয়েছে লঙগোর, বারোবিড়াল, বেজী, ভিন্ন ভিন্ন ধরণের গুইসাপ।

মরহুম সফিউদ্দিন মন্ডল শাহ’র ছেলে পাখিপ্রেমি মো. জাফরুল হক শাহ্ বলেন, আমি আমার বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসছি আমাদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে পাখিদের অভয়ারণ্য।এখানে দিনরাত পাখিরা অবস্থান করে। পাখিগুলো দেখতে খুবই ভালো লাগে। এরা দিনরাত প্রায় সময়ই কিচিরমিচির করে থাকলেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না। তিনি আরো জানান, প্রতিবছর শীতকালে পাখিদের বিচরণ দেখা গেলেও এবার এখনো অসংখ্য পাখি রয়েছে। প্রতিবছরই পরিযাত্রী পাখিতে মুখরিত থাকে বাড়ির চারপাশ। পাখির এ অভয়ারণ্য দেখতে ছুঁটে আসেন পাখিপ্রেমিরা।

মরহুম সফিউদ্দিন মন্ডল শাহ’র নাতী মো. তুহিন শাহ্ জানান, আমি অন্তত ১০ বছর ধরে এসব পাখি দেখভাল করছি। সারাদেশে পাখি শিকারের মহোৎসব চললেও চেয়ারম্যান বাড়ির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে কেউ পাখি শিকার করে না। পাখিদের কেউ উৎপাত করে না। কেউ করে না বিরক্তও। তারপরেও অনেক সময় বিলে বা জমিতে পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে গেলে তখন দুষ্ট প্রকৃৃতির কিছু লোকজন পাখি শিকার করে। এ নিয়ে ওইসব লোকদের সাথে অনেক সময় মনোমালিন্য হয়। চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজন ও এলাকাবাসী পাখিদেও প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই জানুয়ারি মাস থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসে হাজার হাজার পাখি। দূরদেশ থেকে আসে পরিযাত্রী পাখিও।

ভাবকি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রবিউল আলম তুহিন জানান, সরকারি উদ্যোগে পাখি সুরক্ষার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই গ্রামের চেয়ারম্যানবাড়িকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। এতে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং এলাকার মানুষ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাবে।

সরজমিনে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি দেখে মনে হবে এ যেন পাখি স্বর্গরাজ্য। এলাকাকাসী’র পাখিপ্রীতি আর নিরাপত্তা পেয়ে নিশ্চিন্তে বংশ বিস্তার করছে পাখি। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এই পাখির সংখ্যা। এই পাখিগুলো সংরক্ষনে গ্রামবাসীর রয়েছে অপার মমত্ববোধ।

খাসমামা উপজেলা পরিষদের তিনবারের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ও প্যানেল চেয়ারম্যান জনবন্ধু এটিএম সুজাউদ্দিন শাহ্ লুহিন বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমণ ঘটে এবং জুলাইয়ের শেষদিকে চলে যায়। এবার এখন পর্যন্ত অসংখ্য পাখি আছে। পাখিগুলো বিলে বা জমিতে যখন খাবার আহরণে যায়, তখন দুষ্ট প্রকৃতির কিছু মানুষ পাখি শিকার করে। এটা বন্ধ করা গেলে পাখির আগমণ আরো বৃদ্ধি পাবে।

তিনি আরো বলেন, পাখিগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হলে উপজেলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ পাখির অভয়ারণ্য গ্রাম হিসেবে গড়ে উঠবে। পাখির খাদ্য, নিরাপত্তার পাশাপাশি এসব আবাসস্থলকে টিকিয়ে রাখতে তাগিদ দিচ্ছেন পরিবেশবিদবিদরা।

(এস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২)