ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


পরিবেশের কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ পানির সাথে মিশে পানির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করে, যার ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে এই অবস্থাকে পানি দূষণ বলে।যে পানি জীবের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে, সেই পানিকে দূষিত পানি বলে। তখন এই পানি আর পানযোগ্য থাকে না এবং নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে। আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন...পানি পান না করে আমাদের বাঁচা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে শর্ত হচ্ছে সুপেয় পানি তথা দূষণমুক্ত পানি হতে হবে। দূষিত পানি পান করলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা শতভাগ। ভৌত, রাসায়নিক ও জীবাণুঘটিত মিশ্রণে পানি নিরাপদ ও হিতকর ব্যবহারের অনুপযোগী বা অপেক্ষাকৃত কম উপযোগী হয়ে পড়ে। জীবাণু সংক্রমণজনিত দূষণ এবং পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ বিনিষ্টকারী উপাদানের সংমিশ্রণজনিত দূষণকে সম্মিলিতভাবে পানিদূষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে দূষিত বস্তু বা তরল পদার্থের মিশ্রণ অহরহ সম্মিলিতভাবে পান করার পানিকে দূষিত ও বিবর্ণ করে ফেলছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে ঘরে ঘরে যেসব সাব লাইন দিয়ে পানি সরবরাহ করা হয় সেগুলো বহু দিনের পুরনো। সেসব লাইন ছিদ্র ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। সেসব পাইপ থেকে পানি বেরিয়ে যায় তেমনি সেসব ছিদ্র দিয়ে দূষিত তরল বর্জ্য খাবার পানিতে মিশে যায়। তাতে মানুষ রোগাক্রান্ত হয় এবং তার জীবনী শক্তি হ্রাস পায় এবং একপর্যায়ে তাদের অকালমৃত্যু ঘটে।আর পানি দূষণ হল জলাশয়ের দূষণ (উদ্যান, নদী, মহাসাগর, পানিজ এবং ভূগর্ভস্থ পানি)। পরিবেশগত অবনতি এই ফর্ম যখন দূষণকারী সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিকারক যৌগ পানিতে বা পানিে অপসারণ হয় তখন তা পানি বা পানিে মিশ্রণের ফলে মানব ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠে, আর এটাকেই বলে পানি দূষণ বা পানিদূষণ।

১. শিল্প ও কারখানা

পেট্রো রাসায়নিক শিল্পে, পলিথিন ও প্লাস্টিক শিল্পে, জ্বালানি শিল্পে, খনিজ তেল পরিশোধন শিল্পে, বিভিন্নরকম যানবাহন নির্মাণ, ছোট ও মাঝারি ইলেকট্রিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে প্রচুর পরিমাণে দূষিতরসায়ন পদার্থ যেমন অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড, সায়ানাইড এবং বিভিন্ন ধাতু জিংক, পারদ, সিসা ইত্যাদিপানিে মিশে পানিকে দূষিত করে।

২. গৃহস্থলীর আবর্জনা

গ্রাম এবং শহর এলাকার বিভিন্ন আবর্জনা বর্জ্য পদার্থ যেমন দৈনন্দিন রান্না বস্তু, গৃহস্থলীর কাজেব্যবহৃত পানি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ প্রভৃতি থেকে নির্গত পানি, খাদ্যদ্রব্যের ফেলে দেওয়া অংশ ,শাকসবজির পচা অংশ -ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি জীবাণু মিশ্রিত হয়ে নর্দমা পয়ঃ প্রণালী দিয়ে নদনদী, হ্রদ,খাল ওসমুদ্রের পানি পড়ে পানি দূষণ ঘটায়। বিভিন্ন পানিাশয়ে পানি মানুষের যথেচ্ছ ব্যবহার, মলমূত্র ত্যাগ, গবাদিপশুর স্নান, জামা-কাপর কাচা ইত্যাদি যার ফলে তাতে বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবানু জন্মায় ও পানিকে দূষিত করে।

৩. কৃষিক্ষেত্র থেকে পানিদূষন

চাষের খেতে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছানাশক প্রভৃতি দেওয়ার ফলে সেগুলি পানিতে পড়ে পানিকে দূষিত করে। ছত্রাকনাশক,পতঙ্গনাশক, লেড আর্সিনেট, প্যারিস গ্রীন ,অজৈবপেস্টনাশক, DDT,অলড্রিন ও জৈব কীটনাশক প্রভৃতি এইসব কৃষি ক্ষেত্রের বর্জ্য (Agricultural Run Off) বৃষ্টির পানির সঙ্গে পানিাশয়ে পড়ে পানি দূষিত করে।

৪. তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে পানি দূষণ

পারমাণবিক চুল্লি কেন্দ্র, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ গুলো সমুদ্র বা নদীতে ফেলাহয় যার ফলে পানি দূষণ ঘটে ঘটে।

৫. খনিজ তেল থেকে পানি দূষণ

দুর্ঘটনাগ্রস্ত তেলবাহী জাহাজ থেকে অথবা সমুদ্রে অবস্থিত তেলের খনি থেকে এমনকি সমুদ্র বন্দর থেকেখনিজ তেল মিশে পানি দূষণ ঘটায়।

৬. তাপীয় দূষণ

তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কারখানায় ব্যবহৃত উষ্ণ দূষিত পানি, বর্জ্য পদার্থের সঙ্গেসরাসরি পানিাশয় মেশে অথবা নদীতে মিশে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ও পানি দূষণ ঘটায়।

৭. বায়ুদূষণের কারণে পানি দূষণ

কলকারখানা ও যানবাহনের মাধ্যমে বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ইত্যাদিজমা হয় ও পরে তা অম্ল বৃষ্টি হয়ে মাটিতে তথা পানিাশয় মেশে ও পানি দূষিত করে।

৮. আর্সেনিক দূষণ

মাটির নিচের স্তর থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিরিক্ত পানি তুলে নেওয়ার ফলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গায়আর্সেনিক বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শাক্ত ধাতব যৌগ তৈরি করে পানিকে দূষিত করে ।

পানি দূষণ রোধের উপায়

নগরায়ন, শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে আর পানির লাগামহীন অপচয় দূষণমুক্ত পানির সীমিত ভান্ডার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এই অবস্থায় পানির সঠিক ব্যবহার সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। নিম্নলিখিত উপায়গুলি অবলম্বন করলে সম্ভব হবে –

১. আইন প্রণয়ন ও বলবৎ

পানি ( প্রতিরোধ ও দূষণ) আইন ১৯৭৪-১৯৯৮(সংশোধিত) ও পানি (প্রতিরোধ ও দূষণ) ১৯৭৭-১৯৯১(সংশোধিত) পানি দুষণ আইন প্রয়োগ করে দূষণকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেপানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

২. প্রযুক্তিগত উপায়

দূষিত পানি পরিশোধন করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট বসিয়ে কল-কারখানা, হাসপাতাল,পৌরসংস্থা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত দূষিত পানি কে পরিশোধন করারপর নদ নদী বা সমুদ্রে নিষ্কাশন করতে হবে। গৃহস্থলী ও পৌর আবর্জনাকে প্লান্টে জীবাণুমুক্ত করলে পানিদূষিত হয় না।

৩. কাপড় কাচা, সাবান মাখা ও স্নান

পানি এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে, কড়া ক্ষারের পরিবর্তে অল্প ও মৃদু ক্ষার যুক্তডিটারজেন্টদিয়ে কাপড় কাচলে পুকুর, পানিাশয়, নদ-নদীতে কম দূষণ হয়। গবাদি পশুর স্নান, প্রতিমা বিসর্জন বন্ধকরলে পানি দূষণ কম হয়।

আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ পানিকে সেভাবে গুরুত্বসহকারে নেই না। অথচ সুপেয় পানির অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই কমছে বিশুদ্ধ পানির উৎস।

মানবজীবনে পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলেও আমাদের দেশে সুপেয় পানি প্রাপ্তি একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশেষকরে ভূগর্ভস্থ পানির মজুুত দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা আমাদের দেশসহ বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বিশুদ্ধ পানির সীমাবদ্ধতা

আমাদের দেশে সুপেয় পানির সংস্থান হয় ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ এই দুই উৎস থেকে। অথচ কল্পনাতীত পানি দূষণের ফলে বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার আজ নেই বললেই চলে। তাই বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক আধার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থান থেকে আমাদের দেশের বিশুদ্ধ পানির ভবিষ্যৎ সংস্থান চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে।

সমগ্র পৃথিবী আজ বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে যথাসাধ্য ব্যবহার করছে। অথচ এই উৎস লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে সাধারণ মানুষ সেই সম্পর্কে জানতে পারছে না। যেহেতু এটা সসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সেহেতু এই সম্পদের অপচয়, অবহেলা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই সম্পদকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই আমাদের সকলের উচিত পানি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, পরিমিত ব্যবহার ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা রাখা। তা না হলে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা থেকে খুব সহজে আমাদের উত্তরণের কোনো পথ নেই।

দূষণরোধ করতে যা করা প্রয়োজন

বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ব্যাপক পানি দূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। তাই এখনই আমাদের উচিত ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পানিদূষণ বন্ধ করা। আর পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী খালবিল, সমুদ্র ইত্যাদি। তাই ভূ-উপরিস্থ পানিকে পানিদূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদ-নদীতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও সেনিটারি বর্জ্যের মিশ্রণরোধ করা অত্যাবশ্যক।

নদীতীরে শিল্পকারখানা নির্মাণ বন্ধ, সেই সঙ্গে দেশের বড় বড় শিল্প জোনের শিল্পকারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক।

নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণসহ মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যের মিশ্রণ প্রতিহত করতে হবে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে মিশতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ পানি দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদ-নদী দূষণরোধে দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

আর আমাদের জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান নির্ধারণ করতে গেলে পানির অধিকারকে অন্যতম মৌলিক পূর্বশর্ত হিসেবে মানতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য এটিকে একটি মৌলিক পূর্বাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা বাড়বে ৪০ শতাংশ। এখন যে পরিমাণ পানি আছে, তাতেই আমাদের প্রচণ্ড হাহাকার। ফলে নতুন করে বিশুদ্ধ পানি কোথা থেকে আসবে, তা কেউ জানে না। বিদ্যমান পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আর পানির অপচয় রোধ করেই আমাদের এগোতে হবে। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় ৯০ শতাংশের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ভূ-উপরস্থ পানিতে ফেলা হয়। এর অর্থ আমাদের ভূ-উপরস্থ পানি শিল্পবর্জ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শহর এলাকায় অর্ধেকের বেশি মানুষ বস্তিতে বসবাস করবে, যেখানে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা থাকবে না। বিশ্বের ৮৮৪ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ খাওয়ার পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন লোক বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানির অধিকার এবং পানির কথা আমরা বলি। এখানে সাম্য প্রতিষ্ঠা একটি বড় ব্যাপার, যা বাংলাদেশ এবং বিশ্ব বাস্তবতায় একইভাবে প্রযোজ্য। বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে একজন দরিদ্র নাগরিককে প্রতি লিটার পানির জন্য অবস্থাসম্পন্নদের তুলনায় ১২ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটি বৈশ্বিক পরিসংখ্যান। বলা হচ্ছে, বিশ্বে প্রতি বছর ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন গ্যালন পানির অপচয় হয়।

আমরা নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি চোখে দেখা যায় না বলে পানি বললেই মানুষ সাধারণত নদ-নদীর পানিকে বোঝে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের অনেক বেশি নির্ভরতা । পানিরক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সুরক্ষার কথা বলতে গেলে সবাই শুধু নদী রক্ষার কথা বলে। দৃশ্যমান হওয়ায় নদীর পানির বিষয়টি দ্রুত আমাদের সামনে আসে সত্য। কিন্তু কৃষি, সুপেয় পানি ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের নির্ভরতা অনেক। অথচ ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণে আমরা একেবারেই মনোযোগী নই। এগুলো সংরক্ষণে নাগরিক আন্দোলনের অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী বিশ্বের ৬০ শতাংশ মিঠা পানির চাহিদা পূরণ করে। ১৪৫টি আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল। বিশ্বের জলরাশির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয় ফসল উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় এবং পানীয় জল হিসেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও আমরা পানি ব্যবহার করি।

এবার বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে আসি। শুধু ঢাকাতেই ওয়াসার গভীর নলকূপ আছে এক হাজার। আর বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রয়েছে সাত হাজার। প্রতি বছর তিন মিটার করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। খরায় আক্রান্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর। ঢাকায় প্রতিদিন পানির চাহিদা প্রায় ২৫০ কোটি লিটার এবং এটি বাড়ছে। ঢাকার সঙ্গে পাহাড়ি এলাকা বা উপকূলীয় অঞ্চলের তুলনা করলে দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকায় একজন মানুষকে পানি সংগ্রহের জন্য গড়ে ২ ঘণ্টা হাঁটতে হয়। আর মোট আয়ের ২৫-৩০ শতাংশ খরচ হয় শুধু পানির জন্য। তার পরও উপকূলীয় এলাকার ২৩ শতাংশ মানুষ লবণাক্ত ও অনিরাপদ পানি পান করে। জাতিসংঘের এক গবেষণায় উঠে এসেছে ৭৪ শতাংশ পানি সংগ্রহের কাজ নারীরা করেন। ৬৩ শতাংশ মানুষের খাওয়ার পানি পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ৭৫ শতাংশ মানুষ হ্যান্ড টিউবওয়েলের ওপর নির্ভর করে, যদিও অনেক এলাকায় সেগুলো থেকে ঠিকমতো পানি মিলছে না। প্রায় ৪১টি জেলায় আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পয়োবর্জ্য দিয়ে দূষিত পানি পান করে ৪১ শতাংশ জনগোষ্ঠী। কেবল ৩৪ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। ১ কোটি ৯৪ লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানির মুখোমুখি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় পানি একটা সাম্যের বিষয়। খুব রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও দেখা যায়, উপকূলের মানুষ পানি পেতে ঢাকার মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি খরচ করে। ৭০ শতাংশ বস্তিবাসীর পানি পাওয়ার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। একজন নগরবাসী হিসেবে আমি ১৪০ লিটার পানি পেলেও সেই অনুপাতে একজন বস্তিবাসী পায় ২০ লিটার পানি। সরকার পানির জন্য যত অর্থ ব্যয় করে, তার ৮০ শতাংশই খরচ করে শহরের মানুষের জন্য। মাত্র ২০ শতাংশ খরচ করে গ্রামের মানুষের জন্য। কৃষি খাতে পানি বেশি অপচয় হয়। বাংলাদেশে পানি প্রাপ্যতার আরেকটি উদীয়মান সমস্যা জলবায়ু পরির্তনের চ্যালেঞ্জ ও প্লাস্টিক দূষণ। সমুদ্রের আগ্রাসনের জন্য আমাদের সুপেয় পানির অনেক আধারই লবণাক্ত হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে এটি আরো বাড়বে। আমাদের জলাশয়গুলোয় প্লাস্টিক দূষণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ বলছে, বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৭৭০। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ৪০৫টি। নদনদীর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ খুবই জরুরি।

দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুপেয় পানির বড় সংকট তৈরি হচ্ছে। এশিয়া প্যাসিফিকের নদীর পানির মধ্যে বাংলাদেশের নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে ২৯টি নদী মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার। তাছাড়া বাংলাদেশে জলাভূমি হারানোর হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আমাদের সংবিধানে জলাশয় রক্ষাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা রয়েছে। জীবনের অধিকার পানি অধিকারের সমার্থক। পানি ও সুস্থ বাতাসের অধিকার না থাকলে জীবনের অধিকার অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। পানি সরবরাহের জন্য শহর এলাকায় ওয়াসা আছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো। পানি নিয়ে কায়কারবার করে এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকা বেশ দীর্ঘ। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে উচ্চ আদালতে রায় হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করে নদ-নদী ও জলাশয়ের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। ভূমি দখলকে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে এ রায়ে। তার পরও নদী দখল থেমে নেই। দখলের কারণে মেঘনা থেকে ঢাকা শহরে পানি আনার প্রকল্প থেকে দাতা সংস্থা অর্থ প্রত্যাহার করছে। মেঘনায় দখলদারদের উচ্ছেদে সরকারের দৃশ্যত উদ্যোগ নেই। উপকূলীয় এলাকা, দক্ষিণাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সংকট প্রকট। এ তিন অঞ্চলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক বনায়ন করার কারণে সব ঝরনা শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব প্লান্টেশনের একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সমীক্ষা করে এগুলো বন্ধ করে সেখানে প্রাকৃতিক বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পার্বত্য এলাকার নদীগুলো থেকে বালি ও পাথর উত্তোলনে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো নদীর পানি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। উপকূলীয় এলাকার জন্য অবশ্যই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কথা ভাবতে হবে। গোটা দেশের পানি প্রাপ্যতা ম্যাপিং করে সেই তথ্যগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। নইলে মানুষ সচেতন হবে না। ডিপ টিউবওয়েল নিরুৎসাহিত করতে হবে। জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে।

মারাত্মক দূষণের শিকার ২৯টি নদীকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করতে হবে। দূষণকারী ও দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এখন পর্যন্ত একটি নদীও সরকার পূর্ণ দখলমুক্ত করতে পারেনি। দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে হলেও নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। নদী দূষণ ও দখলের শিকার হলে কীভাবে প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যায়, তার একটা মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। দূষণ ও দখল বন্ধে সোচ্চার হতে হবে। পানি ব্যবহারে রেশনিং করতে হবে।

স্বাস্থ্য তথ্য

পানির অপর নাম যখন জীবন।পানি ছাড়া আমাদের অস্তিত্বও চিন্তা করা যায় না। সুপেয় পানির প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পানি সুস্থ জীবনের জন্য একটি আবশ্যক উপাদান। কিন্তু সুস্থ জীবনযাপনে একজন মানুষের প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করা জরুরি?

বিশেষজ্ঞরা বলেন-আমাদের শরীরের ৭০ ভাগের বেশিই হচ্ছে পানি, এজন্য সারা বছরই পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। তবে স্বাভাবিক পানির চাহিদা কিন্তু একেক জনের আলাদা।যেমন -

> শিশুদের, পুরুষ ও নারীর পানির চাহিদাও ভিন্ন। আবার যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন, নিয়মিত ব্যায়াম করেন তাদের অন্যদের তুলনায় বেশি পানি পান করতে হবে।

> নারীদের প্রতিদিন ৬-৮ গ্লাস

> ব্যায়াম বা ভারী কাজ করেন এমন নারীরা ৮ থেকে ১০ গ্লাস

> পুরুষের জন্য ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানিই যথেষ্ট, তবে যারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন তারা ১০ থেকে ১৪ গ্লাস পানি পান করুন।

আর প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান শরীরের জন্য খুব উপকারী। রাতের ঘুম শেষে উঠে খালি পেটে পানি পান করুন। যতটুকু পারবেন ততটুকুই পান করুন। দিনের শুরু হোক পানি পানে।
পরিশেষে, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা আর পানির উৎসের কার্যকর ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হবে বিশ্ব পানি দিবসে এই প্রত্যাশা আমাদের।

উত্তরণের উপায়

ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ হারে বাড়াতে হবে। বিশেষকরে পানিদূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি নদীনালা, খালবিল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে খনন করতে হবে। যাতে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুত বাড়ে।

কোনো প্রকার প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক জলাশয় যেমন— হ্রদ, পুকুর, দিঘি, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এসব রক্ষা করতে হবে। গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় বেশি বেশি ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ব্যবহৃত পানিকে পরিশোধন করে পুনঃব্যবহার করতে হবে।

সারা দেশে ব্যাপক প্রচারণা করে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে। সে সঙ্গে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই নয় সরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূ-অভ্যান্তরে প্রবেশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নতি হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, সারাবিশ্বে ব্যাপকহারে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে এই পানির মজুত আজ হুমকির মুখে। তাই এই বছরের পানি দিবসের লক্ষ্য হলো ভূগর্ভস্থ পানি সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষকে আরও বেশি সচেতন করা। যাতে বিশুদ্ধ পানির এই উৎস সম্পর্কে মানুষ আরও বেশি সজাগ হয়।

বিশেষকরে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, দূষণরোধ এবং এর বিকল্প উৎসের সংস্থান করা। যাতে করে পৃথিবী আরও বেশিদিন এই উৎস থেকে পানি আহরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানিদূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানিও যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মখে পড়বে। তাই আমাদের সবার উচিত এই বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।