ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস। যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাদেশে আজ এ দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে। পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী, শিক্ষা সংকোচনমূলক শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিন এই শিক্ষা দিবস।আজ থেকে ৬০ বছর আগে এই দিনে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া 'শরীফ কমিশনে'র শিক্ষানীতি প্রতিহত করতে গড়ে উঠেছিল ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন 'অল-পার্টি স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি' দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লেলিয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মোড়ে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজীউল্লাহ প্রমুখ শহীদ হন। সেই থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্র সংগঠন প্রতিবছর দিনটিকে 'মহান শিক্ষা দিবস' হিসেবে পালন করে আসছে।সবাই জানি, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষা ছাড়া উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণ কল্পনামাত্র। তাই একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিলেই হয়।

আগে দেখা গেছে, অনেক বড় বড় যুদ্ধে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরি ধ্বংস করে দিয়েছে যেন সে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবগত না হতে পারে।সেদিন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান গঠিত শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতির প্রতিবাদে ছাত্রদের আহুত হরতালে পুলিশের দফায় দফায় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পরেই (৩০ ডিসেম্বর, ১৯৫৮) এই শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। ‘শরীফ কমিশন’ নামে খ্যাত এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা ছিল প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে।

প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- সস্তায় শিক্ষা করা যায় বলে যে ভুল ধারণা রয়েছে তা ত্যাগ করতে হবে। এতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।

এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল।রিপোর্টে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল। ছাত্ররা আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। এক পর্যায়ে মিছিলে পুলিশ পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি বর্ষণ করে।

সরকারি হিসাবে একজন নিহত, ৭৩ জন আহত এবং ৫৯ জনকে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়। তবে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল- ৩ জন নিহত হয়েছেন। সেদিন সারাদেশেই মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়।

শিক্ষা বলতে সেই শৃঙ্খলাকে বোঝায় যা স্কুল বা স্কুলের মতো পরিবেশে শিক্ষাদান এবং শেখার পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত। শিক্ষা হল পদ্ধতিগত নির্দেশনা গ্রহণ বা প্রদানের প্রক্রিয়া, বিশেষ করে একটি স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা হল শিক্ষাদান, প্রশিক্ষণ এবং শেখার একটি প্রক্রিয়া, বিশেষ করে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের উন্নতি এবং দক্ষতা বিকাশের জন্য প্রদান করা হয়। শিক্ষা প্রধানত তিন প্রকার, যথা, আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক এবং অপ্রথাগত বা উপানুষ্ঠানিক।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন...সবাই জানি, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষা ছাড়া উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণ কল্পনামাত্র। তাই একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিলেই হয়।

আগে দেখা গেছে, অনেক বড় বড় যুদ্ধে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরি ধ্বংস করে দিয়েছে যেন সে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবগত না হতে পারে। আর আমাদের গৌরবময় সব সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিক গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের ফলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর প্রায় অর্ধডজন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীন দেশে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের বিপুল সমর্থনে সরকার গঠনের পর দেশের সব রাজনৈতিক মতবাদ এবং সমাজের নানা চিন্তার সব অংশের মানুষের মতামত গ্রহণ করে সব চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে তা অনুমোদন করা হয়। এ জন্য সরকারকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। আমাদের দেশে এই প্রথম সরকারি ও বিরোধী দলসহ জাতীয় ঐকমত্যে একটি জাতীয় মৌলিক নীতি, যা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

এই শিক্ষানীতিতে ছাত্রসমাজ ও জাতির ৬০ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটেছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষ্য, একটি দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল স্বাধীন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করে গড়ে তোলার লক্ষ্য ও সুনির্দিষ্ট করণীয় এরই মধ্যে নির্ধারিত হয়েছে। আর আমাদের স্মরণে রাখা উচিত- সেদিন বাবুল, গোলাম মোস্তফাদের রক্ত রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, সঞ্চালিত হয়েছিল জাতির ধমনিতে, মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায়। আর ওই রক্তের স্রোত গিয়ে মিশেছিল আরেক রক্তগঙ্গায়। অবশেষে গিয়ে মিলিত হয় স্বাধীনতার মোহনায়।

তাই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সার্বজনীন মতামতের ভিত্তিতে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষা হবে সবার জন্য অবাধ। ‘শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা সবার অধিকার’ এটি সর্বস্তরে প্রতিফলিত হোক মহান শিক্ষা দিবসে।

তাৎপর্যপূর্ণ মহান শিক্ষা দিবসের ইতিহাস মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিনটি পালনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। শিক্ষা দিবসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গ্রাম ও শহরের মাঝে শিক্ষা বৈষম্য দূর করতে হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০

১. শিক্ষার সকল স্তরে সাংবিধানিক গ্যারান্টি প্রতিফলিত করা এবং শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার সম্পর্কে সচেতন করা।

২. শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যবহারিক গুণাবলীকে উদ্দীপিত করা যাতে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা এবং দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং ভালো নাগরিক গুণাবলী বিকাশ ঘটানো (অর্থাৎ ন্যায়বিচার, অসাম্প্রদায়িকতা, কর্তব্যপরায়ণতা, মানবাধিকারের সচেতনতা, মুক্ত চিন্তা ও শৃঙ্খলা, সৎ জীবন, সহনশীলতা, এবং অধ্যবসায় ইত্যাদি)।

৪. জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরস্পরায় প্রচার করা।

৫. দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততায় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা গড়ে তোলা যাতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের জীবনমুখী বিকাশের দিকে পরিচালিত করে।

৬. দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীকে সৃজনশীলতা, ব্যবহারিকতা এবং উৎপাদনশীলতার উপর ভিত্তি করে এমন একটি শিক্ষা প্রক্রিয়া বিকশিত করা। শিক্ষার্থীদের একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তৈরি করা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশ করা

৭. জাতি-ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা। অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।

৮. বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সবার জন্য শিক্ষার নিরবিচ্ছিন্ন এবং সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা।

৯.গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশের জন্য বিভিন্ন মতাদর্শের প্রতি সহনশীলতা দেখানো এবং জীবনমুখী, বাস্তবসম্মত এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সহায়তা করা।

১০. প্রতিটি স্তরে শিক্ষার্থীদের প্রান্তিক দক্ষতা নিশ্চিত করা যাতে তারা মূখস্ত বিদ্যা থেকে নিরুৎসাহিত হয়, বরং তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, কল্পনা এবং কৌতূহলের জন্য তাগিদ ব্যবহার করে।

১১. শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং শিক্ষার স্তরে উচ্চ মানের দক্ষতা নিশ্চিত করা যাতে শিক্ষার্থীরা সফলভাবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

১২. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া এবং গণিত, ইংরেজি, ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

১৩. শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। শিক্ষার্থীদের শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহ করে তোল। শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের স্ব-কর্মসংস্থানের সুবিধার্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম করা।

১৪. শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু অভিন্ন এবং মৌলিক ধারণা বিকাশের লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তরের স্কুলে নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক বিষয়ের অভিন্ন পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন করা। একইভাবে মাধ্যমিক স্তরেও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে পাঠদান।

১৫. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের যথাযথ সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল, অনুকূল এবং আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করা।

১৬. শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিক বিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে সঠিক নৈতিক চরিত্রের সাথে বড় হতে সাহায্য করা।

১৭. প্রতিটি স্তরে শিক্ষার যথাযথ মান নিশ্চিত করা এবং পূর্ববতী স্তরে অর্জিত জ্ঞান এবং দক্ষতার ভিত দৃঢ় করে পরবর্তী স্তরের সাথে সমন্বয় স্থাপন করা। এই ধরনের জ্ঞান এবং দক্ষতার সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করা এবং শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম করা। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং বৃত্তিমূলক স্তরে যথাযথ অবদান রাখার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা।

১৮. শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ-সচেতনা এবং এসকল বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা।

১৯. সকল শাখায় উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা এবং গবেষণায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের গবেষণার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় গবেষণার অনুকূল এবং পরিবেশ তৈরি করা।

২০. উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা চর্চা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় সেলক্ষ্যে যথাযথ আবহ ও পারিপাশ্বিকতা নিশ্চিত করা।

২১. প্রতিটি স্তরের শিক্ষা প্রক্রিয়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) -এর ব্যবহার প্রসারিত করা।

২২. আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও বিকাশ।

২৩. শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত কার।

২৪. নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্ত সমাজ গঠন করা।

২৫. শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২৬. বাংলা ভাষা শুদ্ধ সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করা।

২৭. শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক গুণাবলীর সুস্থ বৃদ্ধির জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ, খেলাধুলা, খেলাধুলা এবং শারীরিক ব্যায়ামের সুবিধা তৈরির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

২৮. শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা;

২৯. শিক্ষার্থীদের সতর্ক করা এবং তাদের মাদক বা অনুরূপ জিনিস গ্রহণের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করা।

নতুন শিক্ষানীতি ২০২২

প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায় এই রূপরেখার অনুমোদন দেওয়া হয়। গতবছরের সেপ্টেম্বরে, এই রূপরেখার খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

* শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখা ২০২৩ সাল থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এর মধ্যে, ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন ও পাঠক্রমে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, শুধু বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হবে। কিন্তু পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও শিখন কার্যক্রম উভয় থাকছে।

* নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি (SSC) ও এইচএসসি (HSC) পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন (সবার জন্য একই সিলেবাস ও বই) পড়বে। একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগে নিয়ে পড়তে পারবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো,

১. ভাষা ও যোগাযোগ।

২. গণিত ও যুক্তি।

৩. জীবন ও জীবিকা।

৪. সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব।

৫. পরিবেশ ও জলবায়ু।

৬. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

৭. তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি।

৮. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য।

৯. সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা।

১০. শিল্প ও সংস্কৃতি।

প্রাথমিকে পড়তে হবে আটটি বই এবং মাধ্যমিক স্তরে পড়তে হবে ১০ টি অভিন্ন বই। তবে সব শ্রেণিতেই শিখনকালীন মূল্যায়নেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখা ২০২২ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি) এবং শিক্ষাক্রম উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরা। এতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি।

> বাংলাদেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। প্রাথমিক বিদ্যালয় (সরকারী +বেসরকারী)-৮২,৯৮১ টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়- ৫৩,৫৮৯ টি।৮ আগস্ট ২০২১ তারিখে ২৭১টি বেসরকারি কলেজকে সরকারি করার পর দেশে কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯৮টি।

দেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। যেখানে ৮ কোটি ১৭ লাখ পুরুষ ও ৮ কোটি ৩৩ লাখ নারী আর ১২ হাজার ৬২৯ জন তৃতীয় লিঙ্গ।প্রতিবেদনে সাক্ষরতার হারের হিসাবে বলা হয়, দেশের নারী-পুরুষ মিলে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যার মধ্যে অঞ্চলভেদে গ্রামাঞ্চলে ৭১ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ।অন্যদিকে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১১ সালে নারী-পুরুষ মিলে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

পরিশেষে বলতে চাই, উন্নত আধুনিক ও গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেখ হাসিনা সরকার ছিল; এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মহান শিক্ষা দিবসের মাস সেপ্টেম্বরে আমাদের শপথ শহিদদের স্বপ্নসাধ আমরা বৃথা যেতে দেব না। শিক্ষাকে আমরা পণ্য হতে দেব না। সবার জন্য শিক্ষা অবারিত থাকবে। উন্মুক্ত থাকবে সব বয়সের, সব গোত্রের, সর্বজনের জন্য। শিক্ষা এলিট ক্লাসের মধ্যে সীমিত রাখা হবে না। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে শিক্ষার আলো।দিবসটি উপলক্ষে আজ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক দল নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।