শেখ ইমন, শৈলকুপা : রোগমুক্তির আশায় পাকড়গাছের একপাশে মুসলমানরা আদায় করছেন নামাজ আর অন্য পাশে হিন্দুরা করছেন পূজা অর্চনাা। এরপর পাকড় গাছকে উদ্দেশ্য করে মুসলমানরা দিচ্ছেন সালাম, আর হিন্দুরা করছেন নমস্কার-প্রণাম। পরে রোগ মুক্তির জন্য টাকা, পানি, বাতসা, তেল ও কদমা নিয়ে রাখছে গাছের নীচে। নামাজ,পূজা শেষ হলেই পাকড় গাছে থাকা অদৃশ্য শক্তির পড়া তেল ও পানি ব্যবহার করলেই সারছে কঠিন রোগ। আর এমন কঠিন রোগ সারাতে ভীড় করছেন শত মানুষ। অবাক করা এমন ঘটনার জন্ম ঝিনাইদহের শৈলকুপার বিষ্ণুদিয়া গ্রামে।

জানা যায়, ঐ গ্রামের মন্দিরের পাকড়গাছ ঘিরে চলছে নামাজ পূজা ও ঝাড়ফুক। সপ্তাহের বৃহস্পতি,শনি ও মঙ্গলবার চলছে এমন কাজ। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিষ্ণুদিয়া গ্রামের উলফা জোয়ার্দারের ছেলে আমিরুল ইসলাম। সে বিষ্ণুদিয়া গ্রামের কেন্দ্রীয় মসজিদ কমিটির প্রধান উপদেষ্টা। একজন মসজিদ কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হয়ে কিভাবে এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে তা নিয়ে নানামহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নারী পূরুষ রোগ মুক্তির জন্য পাকড় গাছের নীচে ভীড় করছে। এক শ্রেণীর নারী পূরুষ অন্ধ বিশ্বাসে এখানে আসছেন মনের বাসনা পূরণ করতে তবে অনেকেই বলছেন এসব কুসংস্কার আর ভন্ডামী ছাড়া আর কিছুই না।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঐ গ্রামের কালি মন্দিরের পাশেই বিশাল আকৃতির এই পাকড় গাছের অবস্থান আর এখানেই চলে এসব কুসংস্কার আর ভন্ডামি। নতুন কেউ গেলে এর নেতৃত্বে থাকা আমিরুল ইসলাম মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন, পাকড় গাছকে লক্ষ্য করে সালাম দিন হিন্দুদের বলছেন, জয় কালী মা। এরপর মুসলমান নারী-পুরুষরা গাছকে ঘিরে একপাশে নামাজ আদায় করছেন আবার অন্য পাশে হিন্দুরা করছেন আরাধনা পূজা অর্চনা। পাকড় গাছের গোড়াই প্লাস্টার করা বেদিতে হিন্দু-মুসলমান নারী,পুরুষ ও যুবতিরা শুয়ে করছেন কান্নাকাটি। সপ্তাহের ৩ দিন বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভিড় করছেন এই গাছের নিচে। মাগরিবের নামাজ ও সন্ধার পূজা শেষ হলে সবাই এক সাথে পাকড় গাছ ঘিরে রোগ মুক্তির জন্য আরাধনা করছে। কেউ কেউ টাকা পয়সা নিয়ে এসে পাকড়গাছের নীচে রাখছে। আর এই আসরকে ঘিরে মেলাও বসেছে পাকড় গাছের নীচে।

বিষ্ণুদিয়া কালীমন্দীরের দায়িত্বে থাকা নাগিরহাট বাজারের স্বর্ণকার সুবাস দেবনাথ বলেন, বছরখানের আগে বিষ্ণদিয়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম কঠিন একটি রোগে দীর্ঘদিন ভূগছিলেন। অনেক চিকিৎসার পরও ভালো হচ্ছিলেন না। এরপর স্বপ্নে দেখেন কালীমন্দীরের পাকড় গাছে মানত দিলে সে ভালো হবে। তারপর সেখানে মানত পরিশোধের পর সে সুস্থ্য হয়েছেন। রোগমুক্তির পর আমিরুল ইসলাম তাদের মন্দীরটা জাগ্রত করতে বলে। এরপর থেকে তারা মন্দীরে পূনরায় সপ্তাহে তিন দিন বৃহস্পতি, শনি ও মঙ্গলবার সেখানে আরাধনা পূজা,অর্চনা করতে শুরু করেন। আমিরুল সেখানে মুসলমানদের জন্য পাকড় গাছের এক পাশে মাগরিবের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। তারপর থেকে এখানে বিভিন্ন এলাকার মানুষ রোগ মুক্তির জন্য টাকা, তেল পানি, বাতসা ও কদমা নিয়ে পাকড় গাছের নীচে রাখে। মাগরিবের নামাজ ও সন্ধার পূজা শেষ হলে সবাই এক সাথে পাকড় গাছ ঘিরে রোগ মুক্তির জন্য আরাধনা করতে থাকে। কেউ টাকা পয়সা দিয়ে গেলে পাকড় গাছের নীচে রেখে যায়।

মন্দীরের পাকড় গাছ ঘিরে নামাজ পুজা ও ঝাড়ফুক নিয়ন্ত্রকারী বিষ্ণদিয়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। দেশে বিদেশে চিকিৎসা হয়ে তার রোগ ভালো হয় না। পরে তিনি স্বপ্নে দেখতে পান গ্রামের মাঠের পাকড় গাছে এমন কেউ থাকেন যার কাছে রোগ মুক্তি চাইলে সে ভালো হয়ে যাবে। তারপর তিনি সেখানে রোগমুক্তি কামনা করে সুস্থ হয়েছেন। এরপর তিনি নাগিরহাট বাজারের সুবাস দেবনাথকে বলেন, তোমাদের পুরাতন কালীমন্দীরটা খুব জাগ্রত। সেখানে পাকড় গাছে মানত করে আমার কঠিন রোগ ভালো হয়েছে। এরপর থেকে পাকড় গাছের একপাশে হিন্দুরা সন্ধায় পূজা ও আরেক পাশে তিনি মাগরিবের নামাজ আদায় করতে থাকেন। এরপর বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্ধায় নারী পুরুষ রোগ মুক্তির জন্য পাকড়গাছে আসতে শুরু করেন এবং অনেকেই সুস্থ্য হচ্ছেন বলে জানান। তবে এর জন্য আলাদা কোন টাকা তিনি নেননা বলে জানান।

পাকড় গাছে মানত নিয়ে আসা কমলা রানী জানান, বিষ্ণুদিয়া মন্দীরের পাকড় গাছে যে যে রোগ মুক্তির জন্য আসে তা ভালো হয়ে যায়। সপ্তাহে ৩দিন চলে এ কাজ। আছরের নামাজের পর থেকে হিন্দু-মুসলিম আসতে থাকে। মন্দীর প্রাঙ্গনের এক পাশে মুসলমানরা মাগরিবের নামাজ পড়ে অন্য পাশে হিন্দুরা পূজা শুরু করে। নামাজ-পূজা শেষ হলে হিন্দু মুসলিম সবাই পাকড় গাছ ঘিরে আরাধনা করতে থাকে রোগমুক্তির জন্য। এরপর গাছের গোড়া থেকে অদৃশ্য পানি পড়া নিয়ে সবাই বাড়ি ফেরেন। সবই নিয়ন্ত্রন করেন বিষ্ণুদিয়া গ্রামের আমিরুল নামের এক ব্যক্তি বলে জানান।
৯নং মনোহরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি বিষ্ণুদিয়া গ্রামের এ কুসংস্কারের কথা শুনেছেন। ঘটনাটি নিয়ে তিনি দু:খ প্রকাশ করেন।

ঘটনাটি নিয়ে শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি তিনি জানেন না। খোজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান।

(এসআই/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২)