প্রবীর মৈত্র


কালিকা পুরান ও কৃত্তিবাস রামায়ন অনুযায়ী স্বয়ং রাম দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। এক সময় বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব এই দুর্গা পূজা শুধুমাত্র অবস্থাপন্ন বা জমিদারবাড়ীগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তিকালে মূলত: বৃটিশ শাসনামলে দুর্গা পূজা সার্বজনীন হয়। সেই সময় থেকে দুর্গাপূজা উৎসবের চেহারা পেতে শুরু করে। তথ্য অনুযায়ী বারোয়ারি দুর্গা পূজার সূচনা ১৯৭০ সালে গুপ্ত পাড়ায় (ঢাবুরিয়া, দক্ষিণ কলকাতা), অনেক অনেক পরে কলকাতায় ১৯১০ সালে প্রথম বারোয়ারি দুর্গা পূজার সূচনা হয়েছিল।তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।

বর্তমানে দুর্গা পূজা শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত বর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-দেশের সীমানা, অতিক্রম করে প্রায় সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা পেরিয়ে এই অষ্ট্রেলিয়া মাহাদেশেও বিপূল সমারোহে এই পূজা হয়। দুর্গা পূজা সাধরণত: বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী আশ্বিন মাসে বা ইংরেজী সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে উদযাপিত হয়ে থাকে। এই উৎসব ১০ দিন ব্যাপি তবে শেষ পাঁচদিন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ বা ভারতে বিভিন্ন মন্দির ছাড়াও অস্থায়ী প্যান্ডেল করে এই পূজা করা হয়। অষ্ট্রেলিয়াতে সাধারণত: বিভিন্ন কাউন্সিলের কমিউনিটি হল বা স্কুল হলগুলোতে এই পূজা আয়োজিত হয়। দেশে পূজার এক মাস বা তারো অধিক আগে থেকে পূজো পূজো ভাব শুরু হয়।

বাজারগুলো সাজে পূজার বিভিন্ন পোষাক ও সরঞ্জাম নিয়ে। অনেকে কুমার বাড়ীতে দেখতে যায় তাদের মুর্তিগুলো বানানোর সময়। সারাদেশে ব্যবসা বাণিজ্য, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। বাড়ীতে বাড়ীতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জোয়ার আসে, সবার নতুন পোষাক হয়।

এই দুর্গা পূজার এক বিশাল মাহাত্ম্য আছে-মা দূর্গা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে প্রতি বছর পৃথিবীতে আসেন। দুর্গা পূজাকে বলা হয় পৃথিবীর সচেয়ে বড় qeoOutdoor Festival এবং এই উৎসব UNESCO এর Intangible Cultural Heritage List এও স্থান পেয়েছে।

অনেক বছর থেকে দুর্গা পূজা উদযাপিত হয়ে আসছে সিডনিতে। তবে বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালীরা সম্ভবত ১৯৯৫ সালে সিডনিতে দুর্গা পূজা উদযাপন করে। সংগঠনটির নাম ছিল বাংলাদেশ পূজা এ্যাসোসিয়েশন সংক্ষেপে বি.পি.এ যা এখনো আছে। বর্তমানে প্রায় ১৫টি দুর্গা পূজা হয় সারা সিডনিতে। কমিউনিটি অনেক বড় হয়েছে এবং বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে। তাই কালের প্রয়োজনেই এমনটা হয়েছে।

আগে বলেছি প্রায় দশদিন ব্যাপি এই দুর্গোৎসব চলে। তার প্রথমদিন আমরা পালন করি মহালয়া। কথিত আছে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করার পর মহালয়ার দিন কৈলাস পর্বত হতে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তাঁর পতি শিব ও সন্তানদেরকে সাথে নিয়ে। ‘মহালয়া’ বাঙালীদের এক বিশাল উৎসব। ১৯৩১ সনে মহালয়া প্রথম প্রচারিত হয় আকাশবানী থেকে। অনুষ্ঠানটির মূল কণ্ঠই ছিলো শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের। উনি মূলচণ্ডী পাঠ ও বর্ণনা করেন এবং বাংলার অন্যতম সব শিল্পীগণ পরিবেশন করেন দেবীর বন্দনা সংগীতমালা। এখানেও মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়। এখন আসি একটু অন্য প্রেক্ষাপটে। বেশ অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে পূজা এলেই বেশ আতঙ্কে থাকতে হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের। পূজার আগেই শুরু হয় মূর্তি ভাঙ্গন, মন্দির ভাংচুর ইত্যাদি ঘটনা। একটা গোষ্ঠী চায় বাংলাদেশকে একটি ধর্মের মানুষের দেশ বানাতে।

গত বছর দুর্গাপূজার সময় একটি সাজানো মিথ্যা ঘটনা ঘটিয়ে প্রায় সারা বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন করা হয়, অনেক হিন্দুকে খুন করা হয়। এর প্রতিবাদে দেশে ও সারা পৃথিবীতে হিন্দুরা প্রতিবাদ করে। কিন্তু এখনো অপরাধীদের বিচার হয়নি কারো শাস্তি হয়নি। ফলে এ বছরও বিভিন্ন জায়গায় মুর্তি ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা আতংকে আছে আবার কি ঘটে এই বছরে!

উৎসব একটা দেশের উন্নতিতে অনেক অনেক প্রভাব রাখে। তাই উন্নত দেশগুলিতে প্রতি বছরই অনেক নূতন উৎসবের প্রবর্তন করা হয় যেমন মা দিবস, বাবা দিবস ছাড়াও অনেক দিবস। যা হয়তো আগে ছিল না। এর মাধ্যমে কেনাকাটা বাড়ে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নতি হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রিসমাস, ইষ্টার উৎসব ছাড়াও দীপাবলি, Chinese New Year, ঈদ ইত্যাদি নানান উৎসবকে নানান উৎসাহ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী, প্রিমিয়ারসহ অনেক এম.পি শুভেচ্ছা বার্তা জানান। বাজারগুলো নতুন সাজ সজ্জায় মেতে ওঠে। সবাই উপকৃত হয় অনেকের কর্মসংস্থান হয়, অর্থনীতির উন্নতি হয়। সবাই দেশটিকে নিজের ভাবতে শুরু করে।

আশাকরি এগুলো খুব ভালোভাবে পর্যালোচনা করবেন আমাদের জন্ম ভূমির নেতানেত্রীগণ। যে দেশে সংখ্যালঘুরা খুশী থাকে সেই দেশই বেশী সুখী।

লেখক : অষ্ট্রেলিয়াপ্রবাসী