দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


 

ওঁ সর্ব্ব-মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থ-সাধিকে।
শরণ্যেত্র্যম্বকে গৌরি নারায়নি নমোহস্তুতে।।

আমাদের ধর্র্মের নাম সনাতন ধর্ম । আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বী। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ অনেকেই সিন্ধু নদীর নিকট বর্তী স্থানে বসবাস করতেন। তাই প্রচলিত ভাষায় আমরা হিন্দু। আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জগন্মাতা বিষ্ণু শক্তি স্বরুপিনীমা মহামায়ার শক্তি আরাধনা। বছরে দুই বার মা মহামায়ার অর্চনা করা হয়। বসন্ত কালে বাসন্তী পূজা আর শরৎ কালে শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা। শরৎ কালের দুর্গা পূজাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শারদীয় দূর্গোসব বা বড় পূজা হিসেবে উদযাপন করে থাকেন। শ্রী শ্রী দুর্গাদেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে ছিলেন। মা মহামায়া জীবনের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাঁকে দুর্গা (দুর্গতি নাশিনী) বলা হয়। যে শক্তিদৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা, বসন্ত কালে অনুষ্ঠিত দুর্গা পূজা বাসন্তী পূজা নামে অভিহিত। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র ব্রহ্মার পরামর্শে রাবণকে বধ করার জন্য দক্ষিনায়ন কালে দেবী দুর্গার পূজা করেন। সেই থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শরৎ কালে শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা করে থাকেন।

উত্তরায়নের কাল দেব/দেবীর জাগরন কাল। দক্ষিনায়ন কাল দেব/দেবীর নিদ্রা কাল। মাঘ হইতে আষাড় মাস পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ন এবং শ্রাবন হইতে পৌষ মাস পর্যন্ত ৬ মাস দক্ষিনায়ন কাল। শ্রী শ্রী দূর্গা পূজা দুর্গতি নাশিনী মা মহামায়ার শক্তি পূজার্চ্চনা করাহয়। শরৎ কালে শ্রী শ্রী দুর্গা পূজারজন্য পূজার পূর্বদিনসায়ংকালে বোধন করে মাকে জাগ্রত করে নিতে হয়। দুর্গা পূজা বৈদিক পূজা। মাকে জাগ্রত করার মন্ত্রে আছে” রাবনস্য বধার্থায় ..., অকালে ব্রহ্মনা বোধো দেব্যস্তয়ি...। ভগবান শ্রী রামচন্দ্র রাবন বধের জন্য অকালে দুর্গা পূজা করে ছিলেন। শ্রী শ্রী দূর্গা পূজায় মায়েরঅষ্টোওর শতনাম পাঠ করা হয়। দেবতাদের স্তব/স্তুতিতে মা দূর্গা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়ে তাঁদের রক্ষা করেছেন। আমরা মহিষ মর্দ্দিনী রুপের পূজা করি। মন্ত্রে আছে-” প্রভাতে য: স্মরেন্নিত্যং দুর্গা দুর্গাক্ষর দ্বয়ম। আপদস্তস্য নশ্যন্তি তম: সূর্য্যােদয়ে যথা।” দুর্গা পূজা করলে মনোস্কামনা পূরণ ও সর্ব্ব সিদ্ধি লাভ হয়।

সাত্ত্বিক ভাবে র্দুগা পূজা করতে হয়। বৈদিক রীতি অনুসারে পূজার্চ্চনা,স্তব, দেবী মাহাত্ম্য শ্রী শ্রী চন্ডী পাঠও অন্যান্য করতে হয়। দেবত্ব. ধর্ম, সত্য, সাত্ত্বিকতা ও অন্যান্য সব বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাই শক্তি। সে শক্তি আসে সর্ব্ব শক্তির আধার দুর্গা দেবী থেকে। মহর্ষি মার্কন্ডেয় এই পুরানের বক্তা এবং ক্রৌষ্টকি ভাগুরি হলেন শ্রোতা। শ্রী শ্রী চন্ডী মার্কন্ডেয়-পুরান অন্তর্গত। এই শ্রী গ্রন্থে ১৩ টি অধ্যায়-৭০০ টি মন্ত্র ও ৫৭৮টি শ্লোকআছে। এক সময়ে রাজ্য হারা হয়েচৈত্র বংশের রাজা সুরথ ও স্ত্রী, পুত্রাদি দ্বারা বিতারিত হয়ে ধণী বৈশ্য সমাধি একটি তপোবনে আশ্রয় নিলেন। মায়ার কারণে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি রাজ্যের প্রজা ও অন্যান্যদের জন্য চিন্তিত। দুই জনে পরামর্শ করে ঐ তপোবনে সাধনা রত মুনি মেধার নিকটে গেলেন।তাঁরা মুনি বরের কাছে এই মায়ার কারণ জানিতে চাইলেন। মেধা মুনি তাঁদের দু’জন কে বললেন- এ সব হচ্ছে মা মহামায়ার মায়া। আরাধনা/তপস্যা করে মা মহামায়াকে তুষ্ট করতে পারলে। তিনি মায়ার পর্দা সরিয়ে নিবেন। মেধা মুনি বললেন- একবার সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা আবির্ভুত হয়ে নিদ্রারুপিণী দেবী ভগবতী যোগমায়া রূপী শ্রী শ্রী দূর্গা মধু ও কৈটভ দুই অসুর কে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবী মহিষা সুর সৈন্য বধ করে ছিলেন।

আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবী মহিষা সুর কে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ দুই অসুর ভাই কে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে অসুর ধুম্রলোচনকে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে শুম্ভ নিশুম্ভের দুই সেনাপতি চন্ড ও মুন্ড কে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে অসুর রক্ত বীজ কে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে অসুরনিশুম্ভ কে বধ করে ছিলেন। আর একবার দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে অসুর শুম্ভকে বধ করে ছিলেন। দেবীর কৃপা লাভের পর দেবতারা দেবীর স্তব মাহত্ম্য কীর্ত্তন করে ছিলেন। ঋষি মেধা রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধির কাছে এই ভাবে দেবীর মহাত্ম্য ও আবির্ভাবের কথা বললেন। সেই দেবী বিষ্ণু মায়া ও মহা মায়ার প্রভাবেই সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ড চলছে। তাঁর দয়াতেই তত্ত্ব জ্ঞান লাভ হয়। তাঁর দয়াতেই সুখ-ভোগ, স্বর্গ, মুক্তি লাভ হয়। শ্রী শ্রী দুর্গা দেবীর মহাত্ম্য কথা শ্রবণ করে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নদীর তীরে বসে মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরী করে দেবী সুক্ত জপ ও অন্যান্য রীতি পদ্ধতি অনুসারে শ্রী শ্রী দুর্গা দেবীর আরাধনা/তপস্যা করলেন। তিন বছর তপস্যার পর তাদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা তাদের সম্মূখে আবির্ভুত হলেন।

শ্রী শ্রী দুর্গা দেবী তাঁদের কে বর চাইতে বললেন। রাজা সুরথ ইহ জন্মে নিজের শক্তি দ্বারা শত্রু সৈন্য বিনাশ করিয়া নিজ তাঁর হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার ও পর জন্মে অক্ষয় রাজ্য পাওয়ারবর চাইলেন। সমাধি বৈশ্যের আর সংসারে দিকে আকর্ষণ ছিল না। তিনি চাইলেন পরম জ্ঞান, আমি ও আমার অভিমান নাশ তত্ত্বজ্ঞান, ব্রহ্ম জ্ঞান ও মুক্তি। যাতে সংসারের সব কিছুর মায়া কেটে যায়। শ্রী শ্রী দুর্গা দেবী বললেন-“তথাস্তু”। মায়ের কৃপায় তাঁদের মনো বাসনা পূর্ণ হলো। মানুষেরা যদি বিপদে পরে ভক্তিভরে দেবী দুর্গা আরাধনা করে তখন মা তাদের দুর্গতি নাশ করেন। দুর্গতি নাশিনী বলে তাঁর নাম দুর্গা।নিত্য বর্তমান রূপী শ্রী শ্রী দুর্গা দেবী সপরিবারে স্বামী শিবের সাথে কৈলাশে থাকেন। প্রথম পুজা অর্থাৎ সপ্তমী পুজার পূর্ব সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রন ও অধিবাস করা হয়। কল্পারম্ভ দিনে মা (সপ্তমী পুজার দিন) পুত্র কন্যাসহ পৃথিবীতে আবির্ভুত হন। মৃন্ময়ী মৃর্তিকেবৈদিক মন্ত্রে প্রান প্রতিষ্ঠা করে চিন্ময়ী করা হয়। এ বারে অর্থাৎ ১৪২৯ সালে মা আসবেন গজে। ফল- শস্য পূর্ণা বসুন্ধরা। মা যাবেন নৌকায়। ফল-শস্য বৃদ্ধি ও জল বৃদ্ধি। দেবী মাহাত্ম্য শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ আছে- তয়াস্মাকংবরো দত্তো যথাপৎসু স্মৃতা খিলাঃ। ভবতাং নাময়িষ্যামি তৎক্ষনাৎ পরমা পদঃ।। (শ্রী শ্রী চন্ডী, ৫/৬)

অর্থাৎ- তোমরা আমাকে বিপদকালে স্মরণ করলেই আমি তৎক্ষনাৎ তোমাদের মহা বিপদ সমূহ বিনাশ করব।
মায়ের নিজ মুখে অঙ্গীকার করা আছে। তিনি দেবতা ও আমাদের রক্ষা করবেন। আমাদের কর্তব্য মাকে স্মরণ করা। শ্রী শ্রী মা দূর্গা যুগে যুগে বিভিন্ন বিপদে আবির্ভূত হয়ে দেবতা ও মানুষদের রক্ষা করেছেন। তিনি বিপদ নাশিনী। সবাইকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে শ্রী শ্রী দূর্গা দেবী আমাদের সকল বিপদ হতে রক্ষা করবেন।

।। ওঁ হ্রীং দূর্গায়ৈ নমঃ।।

লেখক : ধর্ম-তত্ত্ববেত্তা ও অবসর প্রাপ্ত ম্যানেজার (এস.পি.ও), সোনালী ব্যাংক।