সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে হাজারো প্রতিবন্ধকতা এবং অসঙ্গতির মধ্যে ডুবে থেকেও নতুন ভোরের স্বপ্নে প্রজ্বলিত শিক্ষক সমাজের প্রতি প্রথমেই রইল শতকোটি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। একই সাথে সকল সুহৃদ বুদ্ধিজীবী এবং সমাজ স্থপতিদের প্রতি রইল অহর্নিশ শ্রদ্ধা। সকলের সুদৃষ্টি এবং সহমর্মিতার প্রত্যাশায় আজকের এই সামান্য প্রচেষ্টা।  দীর্ঘ সতের বছর এই মহান পেশায় নিয়োজিত থাকার আলোকে বিভিন্ন মিষ্টি তেতো অভিজ্ঞতার মধ্যে আজ এক মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার কিছু অনুভূতি প্রকাশ করছি। 

সমগ্র বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী পিতা-মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। অঞ্চল ভেদে সমীকরণ টা কিছু টা কম বেশি হতে পারে। এসব শিশুদের পিতা মাতা কাজের সন্ধানে শহরে অথবা অন্যত্র অবস্থান করে। বাবা মা বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিবার গঠন হওয়ায় নতুন পরিবার গুলোতে তাদের ঠাই না হওয়ায় অধিকাংশ শিশু পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এই ছোট-ছোট 5 প্লাস শিশুরা তাদের দাদি-নানি বা অন্য কোন নিকটাত্মীয়ের কাছে অবস্থান করে। কিছুটা প্রকৃতির নিয়মে তারা শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসে নিজেকে সমৃদ্ধ করার এক নির্মল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।

কোমল হৃদয়ের এই ছোট ছোট ফুল গুলোকে তাদের স্নেহময়ী মা নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেয় না, নিজ হাতে ব্যাগ গুছিয়ে দেয় না, স্কুলের পোশাক পড়িয়ে চুল আঁচড়ে দেয় না। তাদের বাবা ক্ষেত্রবিশেষে থেকেও নেই। তারা তাদের বাবার আঙ্গুলে ধরে স্কুলে আসার কথা কল্পনাও করতে পারে না। সেই ছোট্ট সোনামনিরা ভারাক্রান্ত মনে জগতের নিয়ম মেনে আসে বিদ্যালয়ে। জ্ঞান নয়, তাদের প্রথম প্রচেষ্টা থাকে আনন্দ কুড়ানো। আর শিক্ষক সমাজ সেই আনন্দের মাঝে জ্ঞান ঢেলে দেবার সুনিপুন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। আমরা শিক্ষক সমাজ তাদের মানসিক অনুভূতি অনুভব করতে সমর্থ। সেই অনুযায়ী আমরা যদি তাদের প্রতি মানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি, তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অনন্য অবদান আশাতীত বৃদ্ধি পাবে। তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

ঊষর মরুর বুকে যদি পানি সহ প্রয়োজনীয় উপাদান সহযোগে বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং যথার্থ পরিচর্যা হয় নিয়মিত তাহলে তার সুমিষ্ট ফল সুনিশ্চিত। নির্ধারিত সময় পর বৃক্ষের আর ততটা পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না, যতটা অত্যাবশ্যক অসহায় কচি মুহূর্তে। ঠিক তেমনি আমরা যদি এই ফুটন্ত ফুল গুলোকে বিদ্যালয়ের স্বার্থকতার জন্য সৌন্দর্য বর্ধনে নিয়োজিত করতে পারি এবং তাদের যথার্ত সমৃদ্ধ করায় সচেষ্ট হই, আদর সোহাগ আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেই, তাহলেই আমার সোনার বাংলা সুনিশ্চিতভাবে সোনা ফলাবে, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

পিতামাতা থেকে তফাতে থাকা শিক্ষার্থীরা সহ সকল শিক্ষার্থীদের খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া, তাদের পরিচ্ছন্ন পোশাকের ব্যাপারে উৎসাহিত করা, তাদের চুল, নখ, দাঁত এবং সর্বোপরি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকার বিষয়ে সুনজর দেওয়া আমরা মানবিক দায়িত্ব হিসেবে পালন করে যাচ্ছই। তাদের প্রতি সামান্য আদর ভালোবাসা অনুভব করতে পেরে কোমল হৃদয় আপ্লূত হয়। ভারাক্রান্ত মন খুশিতে নেচে ওঠে শিক্ষকের সুমিষ্ট ভাষায় এবং আকুলতায়।

আলোচিত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও আমাদের সীমাহীন স্নেহের ছায়াতলে শিখন শেখানো কার্যক্রম উপভোগের মাধ্যমে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে।

আত্মায় আত্মায় যোগাযোগ হবে সকল পাঠ আত্মস্থ হবে। শিখনফল অর্জিত হয়ে যাবে খেলার ছলে। আনন্দঘন ভীতিমুক্ত শিখন শেখানো পরিবেশে। এভাবেই শ্রেণীভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে আমাদের সোনার বাংলার একেকটি সোনার বৃক্ষ এবং সুনাগরিক।

(এসবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২)