রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ৫০টি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার নামে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়ের মেঝেতে কার্পেট , শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম, মাসিক ১২০ টাকা উপবৃত্তি, টিফিনসহ ১৬টি ধরণের বরাদ্দ খাকলেও কেবলমাত্র খাতা বাই ও পেনসিল নিয়ে খুশী থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর আগেই দেওয়ার বিধান থাকলেও দেওয়া হচ্ছে আট মাস পর। বিদ্যালয় ভবনের মাসিক ভাড়া গত নয় মাসে নামমাত্র দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ধরেন না মুঠোফোন।

সাতক্ষীরা জেলা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের এডিপি’র অর্থায়নে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ১১ থেকে ৪৫ বছরের মহিলা ও পুরুষের জন্য ‘মানব উন্নয়নের জন্য সাক্ষরতা উত্তর ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-৪ কার্যক্রম’ বাস্তবায়নে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) অনুমতি পায়। সাড়ে তিন বছর বছর মেয়াদী এই প্রকল্প ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয়েছে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে। তবে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে দেবহাটার ৫০টি বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা।

সূত্রটি আরো জানায়, দেবহাটা উপজেলায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বিদ্যালয় পিছু ৩০ জনের বিপরীতে ৫০টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয় ভবন ভাড়ার জন্য ভ্যাটসহ এক হাজার ৫০০ টাকা মাসিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদের মাসিক উপবৃত্তি বাবদ তাদের অভিভাবকদের বিকাশ নাম্বারে ১২০ টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিদ্যালয় শুরুর আগেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদ্যালয় শুরুতেই শিক্ষার্থীদের ইউনিফরম, ব্যাগ, টিফিন, মেঝেতে কার্পেট, শিক্ষকদের মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনসহ ১৬ প্রকারের বরাদ্দ উলে­খ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৪২ মাসে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ভ্যাটসহ সাড়ে তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া কোন শিক্ষার্থী কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় পড়াশুনা চলমান থাকলেও তাকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা যাবে না।

সরেজমিনে গত শুক্রবার দেবহাটার দেবীশহর, সখীপুর, টাউনশ্রীপুর, চাদপুর ও চণ্ডিপুরসহ কয়েকটি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে দেখা গেছে,অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সরকারি নিয়মের ব্যত্তয় ঘটিয়ে কার্যক্রম চলছে। কোথাও মেঝেতে কার্পেট নেই। নেই কোন শৌচাগার, ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের বই, খাতা ও পেনসিল দেওয়া হলেও কোথাও কোথাও তা পর্যাপ্ত নয়। ব্লাক বোর্ডে ব্যবহৃত চখ ব্যবহার অনুপযোগী। কোনদিনও টিফিন, ইউনিফরম, স্কুল ব্যাগ ও উপবৃত্তির টাকা না পেলেও প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ২৮ জন শিক্ষাথী ক্লাসেন আসে। তবে মোবাইল ফোনে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং অনেকেই সরাসরি সরকারি প্রাথমিক বিদালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রসায় পড়েও উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসেন বলে জানান।

দেবীশহর উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যায়ের শিক্ষার্থী দেবীশহর দাসপাড়ার বাসুদেব দাসের ছেলে প্রেমাদাস জানায়, সে এখন শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। বর্তমানে দেবী শহর উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। একই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর পড়ুয়া শাহাদাৎ হোসেন, পল­বী দাস, পায়েল দাস, তৃতীয় শ্রেণীূর রাশি দাস, রুপালী দাস, জয়ন্ত দাস, ৫ বছরের কম বয়সী পাখি দাস, একই বয়সের সাগরিকা দাস, সৃষ্টি দাস, পরশ দাস, আরিয়ান দাস, দিয়া দাস, শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মিঠুন দাস, একই শ্রেণীর পড়ুয়া বিশ্বজিৎ দাস, হাদয় দাস, হাদিপুর আহছানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষ্ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র চয়ন দাসসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হয়ে জানান, তারা সময় পেলে এ স্কুলে যান।

দেবীশহর দাসপাড়ার দীনবন্ধু দাস বলেন, গতবছরের ১৫ ডিসম্বের থেকে বিদ্যালয় শুরু হয় তার বাড়িতে। বর্তমানে রাস্তার পাশে বাশের তৈরি জিনিসপত্র রাখার ঘরটি বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সব মিলিয়ে গত নয় মাসে তিনি পেয়েছেন ভাড়া বাবদ দুই হাজার টাকা।

দীনবন্ধু দাসের পুত্রবধু সুবর্ণা দাস জানান, এ বিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক কামটা গ্রামের রেজাউল ইসলাম। শুরু থেকেই তাকে মাসিক কিছু টাকা দেওয়ার কথা বলে ৩০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস করতে বলেন। সে অনুযায়ি তিনি শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করলেও রেজাউল তাকে কোন টাকা দেনননি। তবে রেজাউল ইসলাম তিন থেকে চার মাসের বেতন মাসিক ৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন বলে জানান তিনি। শিক্ষার্থীদের ২০ জনেরও বেশি শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে বলে জানান তিনি। খাতা, পেনসিল ও বই তাদের সম্বল। অন্য কোন সুবিধা পায়নি শিক্ষার্থীরা।

সখীপুর উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেয়ে দেখা গেছে, পার্শ্ববর্তী তপন বিশ্বাসের ছেলে ৫ বছরের এক বেশি বয়সী গৌরাঙ্গ বিম্বাস ওই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। জেলেপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ফাল্গুনী মণ্ডল, একই শ্রেণীর খুশী বিশ্বাস, পিলের মাঠের ইসমাইল হোসেন, জারিক , তায়েবা, অফিবাসহ অনেকেই শিশু। এ ছাড়া ৯ থেকে ১০জন জেলেপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। বিদ্যালয়ের ভবনটি সরকারি কাস জায়গায় নির্মিত। সেখানে দিনে ইসলামী ফাউণ্ডেশন ও সমৃদ্ধি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জ্যোস্না ন্নদী সমৃদ্ধি নামক শিক্ষ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। এ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা দেবীশহরের মত।

একই অবস্থা টাউনশ্রীপুর, চণ্ডিপুর ও চাদপুরসহ কয়েকটি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাল্েরয়র। আবার কয়েকজন পড়ে মাদ্রাাসায়। ৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে কয়েকজন করে। শিক্ষকরা তিন থেকে চার মাস বেতন পেয়েছেন। মেঝেতে পলিথিন বা মাদুর বিছিয়ে পড়তে হয়। নামমাত্র বাল্ব থাকলেও জ্বলে না আলো।

তবে স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ , সমগ্র সাতক্ষীরা জেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থী মাত্র এক হাজার ৩০০ জন থাকলেও কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থী দেখানো হচ্ছে ১২ হাজার ৬০০। দেড় হাজার শিক্ষার্থীদের দুই তৃতীয়াংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসার চলমান শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে শিশু, যাদের ভর্তির বয়স হয়নি। যেভাবে প্রকল্প চলছে তাতে বরাদ্দের অধিকাংশ টাকাই সাস এর পকেটে যাবে।সব মিলিয়ে সরকারের ২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকার শিক্ষা প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্যে ভেস্তে যেতে বসেছে।

বৃহষ্পতিবার বিকেলে দেবহাটা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সোলায়মান হোসেনের সঙ্গে তার ০১৭১২-০১৯৯৯৫ নং মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সাস এর পক্ষে দেবহাটা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক আল আমিন জানান, প্রকল্পে এ উপজেলায় কত বরাদ্দ হয়েছে তা জেলা কর্মকর্তা কামরুল হোসেন জানান। প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে কিছু বলার আগেই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

সাতক্ষীরা জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কর্মকর্তা হীরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, কোন উপজেলায় কত বরাদ্দ তা নিদ্দিষ্ট করে বলা যাবে না। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, পেনসিল, চক, ব্লাকবোর্ড ছাড়া অন্য কোন খাতে বরাদ্দের টাকা অসেনি। ফলে সমস্যা তো থাকবেই। তবে শিক্ষার্থী ভর্তি করার ক্ষেত্রে অনিয়ম থাকলে ঢাকা থেকে ফিরে তদন্ত করবেন।

(আরকে/এএস/সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২)