আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : প্রায় আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে এখনও প্রতিবছর মহাধুমধামের সাথে সার্বজনীন শারদীয় দুর্গা পুজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তৎকালীন ভারতীয় উপ-মহাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গা মন্দিরে। বরিশালের গৌরনদী পৌর সদরের আশোকাঠী মহল্লার প্রয়াত জমিদার মোহন লাল সাহার বাড়িতে অবস্থিত এ দুর্গা মন্দিরের রয়েছে অসংখ্য অজানা ইতিহাস ও অলৌকিক ঘটনা। ১ অক্টোবর মহাধুমধামের মধ্যদিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও জমিদারের উত্তরসূরীদের নিজস্ব অর্থায়নে আয়োজিত দুর্গা পুজায় হাজারো ভক্তের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে পুরো মন্দির প্রাঙ্গণ। এমনটাই আশা করছেন প্রয়াত জমিদারের নাতী প্রভাষক রাজা রাম সাহা।

আজ মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, রং তুলির শেষ আচরে শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছেন দেবী দুর্গার প্রকৃত রূপ। একইসাথে মন্দিরের বাহিরে চলছে সাজসজ্জার কাজ। এতদাঞ্চলের মধ্যে এ দুর্গা মন্দিরটি সর্ববৃহৎ হওয়ায় প্রতিবছরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মহাধুমধামের সাথে এখানে দুর্গা পুজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

জমিদার বাড়ির উত্তরসূরীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রায় আড়াইশ’ বছরের পুরনো এ মন্দিরটি খ্যাতিমান জমিদার মোহন লাল সাহার উত্তরসূরী প্রসন্ন কুমার সাহার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে জমিদার মন্দির উন্নয়নের কাজ করেন। কারুকার্জ খচিত ঐতিহাসিক এ মন্দিরের ছাঁদের ওপরের চারিপাশের সিংহ মূর্তিগুলো আজও যেন কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে।

জমিদার মোহন লাল সাহার ছেলে সংগীতজ্ঞ প্রয়াত মানিক লাল সাহা ও তার স্ত্রী স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী অরুনা সাহার ছেলে প্রভাষক রাজা রাম সাহা জানান, তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপ-মহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মন্দির হিসেবে এ মন্দিরটিতে ভক্ত দর্শনার্থীরা পূজা অর্চনা করতে ভীড় করতেন। প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার দুর্গা প্রতিমার এ মন্দিরটিতে এখনও পূর্বের ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে। ৪০ গজ দৈর্ঘ্য ও ৩০ গজ প্রস্থ মন্দিরটিতে রয়েছে ৪৫টি স্তম্ভ। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার ও তাদের স্থানীয় সহযোগি রাজাকাররা জমিদার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করেছিলো। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো পাইক পেয়াদাদের ঘরবাড়ি। গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো দূর্গা মন্দিরের অসংখ্য কারুকার্জ খচিত অলংকরণ।

গৌরনদী উপজেলায় জমিদার মোহন লাল সাহার বাড়ি। বাড়ির সামনেই রয়েছে সান বাঁধানো সু-বিশাল দীঘি। জমিদার থাকতেন প্রসন্ন ভবনে। বাড়ির প্রবেশ দ্বারে প্রাচীনতম সু-বৃহৎ দুর্গা মন্দিরে আজও ভক্তরা পূজা অর্চনা করে আসছেন।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, একসময় জমিদার বাড়িতে এ অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের জন্য প্রায় বারো মাসই যাত্রা, জারি, সারী ও পালা গানের আয়োজন করা হতো। ওইসময় হাজার-হাজার মানুষের পদচারনায় মুখরিত ছিলো এ বাড়িটি। প্রভাবশালী ও মানব দরদী জমিদার মোহন লাল সাহার বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম স্বাক্ষী বাড়ির পাশ্ববর্তী পালরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি। এ বিদ্যাপিঠের অসংখ্য শিক্ষার্থীরা মেধা তালিকায় তৎকালীন যশোর শিক্ষা বোর্ডে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন ও বর্তমানে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে আসছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জমিদারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি পালরদী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় এন্ড কলেজের রূপান্তরিত করা হয়েছে।

জমিদারের নাতনী ও প্রয়াত সংগীতজ্ঞ মানিক লাল সাহার মেয়ে লেখিকা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আইভি সাহা বলেন, বংশ পরম্পরায় কালের গন্ডি পেরিয়ে আজও প্রথা ও নিয়মরীতি অনুযায়ী জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ পুজোতে ১০৮টি লাল পদ্ম ফুল, ১০৮টি মাটির প্রদীপসহ আরও অসংখ্য নিয়ম পারিবারিকভাবে প্রচলিত রয়েছে।

বাড়ির প্রবীণ ব্যক্তিদের উদ্বৃত্তি দিয়ে আইভি সাহা আরও বলেন, মা দুর্গা নিজেই মেয়ের রুপ নিয়ে পুজো গ্রহণ করতে এ বাড়িতে এসেছিলেন। লাল পাড়ে সাদা শাড়ি পরে দেবী দুর্গা বাচ্চাদের নিয়ে একটা নৌকায় চড়ে এসে বাড়ির সামনের নদীপাড়ের সান বাঁধানো ঘাটে এসে নামেন। ওই ঘাটে নামার পর নৌকার মাঝি ভাড়া চাইতে গেলে মাঝিকে বলেছিলেন, আমি প্রসন্ন বাবুর মেয়ে, ওনার কাছ থেকে ভাড়া নিও। পরবর্তীতে মাঝি ভাড়া চাইতে গিয়ে প্রসন্ন কুমার সাহাকে বলেন, বাবু আপনার মেয়ে ভাড়া দিতে বলেছেন। বাবু বলেন, কোন মেয়ে? কেমন মেয়ে সে? আমারতো কোন মেয়ে নেই। মাঝির বর্ণনা অনুযায়ী ওইদিন রাতেই প্রসন্ন কুমার সাহা স্বপ্নে ঠিক সেই মেয়েটিকে দেখতে পেলেন এবং মেয়েটিও (দেবী দুর্গা) এই বাড়িতে আসবার কারণ বলেন।

আইভি সাহা বলেন, আমাদের এই বাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে একসময় বাড়ির বড় জায়গাজুড়ে মেলা বসতো। সেসব এখন গল্প এবং ইতিহাস হয়ে গেছে। কলকাতার অনেক বনেদি পরিবারের নিয়মের মতো আমাদের বাড়িতেও আষাঢ় মাসের রথ যাত্রার দিন মন্দিরে দেবীকে নতুন করে বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

পঞ্জিকা মতে, আগামী ১ অক্টোবর ষষ্ঠী পুজার মধ্যদিয়ে দেবীর দুর্গার নবপত্র কল্পারম্ভ, ওইদিন মন্ডপে মন্ডপে বেঁজে উঠবে ঢাক-ঢোল আর কাঁসরের বাজনার শব্দ। ওইদিন থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দশমী বিহিত পুজা বিহীত সমাপনান্তে দেবী বিসর্জন ও দশহরার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিভাবে সম্পন্ন হবে পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গা পুজার অনুষ্ঠান।

(টিবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২)