বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটকে বলা হয় নারকেলের গাছের রাজধানী। নারকেল উৎপাদনে দেশের সব থেকে এগিয়ে থাকা জেলা বাগেরহাটের এখন নারকেল। এই জেলার মানুষের অন্যতম অন্যতম অর্থকরী ফসল হচ্ছে নারকেল। এ জেলার প্রতিটি বাড়ীতেই কম করে হলেও ২০ নারকেল গাছ রয়েছে। জেলার চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি এর ওপর ভিত্তি করে জেলায় গড়ে উঠছে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে নানা কারণে বর্তমানে নারকেল গাছের ফলন কমতে শুরু করেছে। তার সাথে নতুন করে শুরু হয়েছে হোয়াইট ফ্লাই (সাদা মাছি) পোকার আক্রমণ। বর্তমানে জেলার প্রায়ই প্রতিটি নারকেল গাছে হোয়াইট ফ্লাই পোকা আক্রমণে নারকেল গাছের ফলন কমেছে ৬০ থেকে ৭০ এর শতাংস। শুধু ফলন কমে যাওয়া নয় ২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া হোয়াইট ফ্লাই পোকার আক্রমণ এখন মারাত্মক আকার ধারন করেছে। এর প্রভাবে মরতে শুরু করেছে নারকেল গাছ। তবে জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, সংক্রমণ ঠেকাতে কৃষকদের একযোগে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে । একযোগে কীটনাশক প্রয়োগ না করলে নারকেল গাছের এ সংক্রমণ ঠেকানো যাবেনা। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করবে।

সরেজমিনে জেলার সদর উপজেলার কাড়াপাড়া, ষাটগম্বুজ, যাত্রাপুর, ফকিরহাট উপজেলা ও কচুয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখাগেছে, নারকেল গাছের পাতার ওপর কালো আবরণ পড়েছে। পাতার নিচে রয়েছে তুলার মতো সাদা রঙ্গের পোকা। এই পোকাগুলোই বলা হয় হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছি। পোকাগুলো প্রথমে পাতায় ওপর বসে। পরে পাতায় মাকড়সার জালের মতো আবরণ তৈরি করে। এরপর প্রতিদিন এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে ধীরে ধীরে ওই গাছের পাতা নষ্ট হয়ে গাছ দূর্বল হয়ে পরে। গাছের ফল দেয়ার ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে গাছে এ পোকার আক্রমণে একটি সময় গাছ মারা যায়।

বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের কাঠিগোমতি এলাকার কৃষক মোকলেসুর রহমান মন্টু জানান, ‘সাদা সাদা পোকের কারনে, আমাদের নাইরকেল গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। নাইরকেল গাছের মাথি (মাথা) মরে যাচ্ছে। গাছ মইরে যাচ্ছে। ফলণও কমে যাচ্ছে। আমরা এই পোক চিনিনা। আমার মত গ্রামের সবাইর গাছে একই অবস্থা। আমরা এর প্রতিকার চাই’।

ফকিরহাট উপজেলার নলধা-মৌভোগ ইউনিয়নের কৃষক মোবারক হোসেন জানান, ‘আমার ঘেরের পাড়ে (মাছের খামার) প্রায় ১০০টির মত নাইরকেল গাছ রয়েছে। বছরে এই গাছ থেকে আমি লাখ টাকার নাইরকেল বিক্রি করেছি। গত বছর থেকে আমার নাইরকেল গাছের ফলন কমতে শুরু করিছে। এখন ১০ হাজার টাকারও নাইরকেল বেছতি পারতিছি না। গাছের পাতায় সাদা সাদা পোকে ভইরে গেছে। গাছের পাতা কেমন যানি পুইরে যাচ্ছে’।

জেলার কচুয়া উপজেলার বাধাল এলাকার বাসিন্দা কৃষক শেখ মোতাহার জানান, ‘একটা সময় ছিলো, আমাদের ঘেরের মাছ ও গাছের নাইরকেল বেছেই সংসার চলে যেতো। হাট-বাজারে নাইরকেল বেচে ব্যাগ ভরে বাজার করেছি। বাইরের ব্যবসায়ীরা এসে নাইরকেল কিনে নিয়ে গেছে। আগে গাছে কত বড় বড় নাইরকেল হয়েছে। সেই নাইরকেল এখন আর হয় না। তার উপর গত বছর থেকে দেখছি, সাদা সাদা পোকার জন্য গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে, গাছগুলো মরে যাচ্ছে। এই পোকা আগে দেখেছি পিয়ারা গাছে, কলা গাছে। নাইরকেল গাছে এই পোকা কোনদিন দেখিনি। এখন আমরা নাইরকেল বেচতে পারছিনা, উল্টে কিনে খাচ্ছি’।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানাযায়, ২০২১সালে জেলায় ৩ হাজার ৬১৯ হেক্টর জমিতে নারকেল গাছের আবাদ হয়। ওই বছরে জেলায় নারকেলের উপাদন হয় ৩০ হাজার ৯৩৬ মেট্রিক টন। এবছর এখনো নারকেল চাষের হাল নাগাদ হিসাব নেই কৃষি বিভাগের হাতে। তবে, চাষের পরিমান বলতে না পারলেও হোয়াইট ফ্লাই রোগের কারনে বিগত বছরের চেয়ে জেলায় নারকেল উৎপাদন ৬০ থেতে ৭০ শতাংস কম হবে বলে দাবী করছে কৃষি বিভাগ।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান জানান, বর্তমানে বাগেরহাট জেলায় নারকেল গাছে হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছি ব্যাপক ভাবে আক্রমন করেছে। এটি আসলে ২০১৯ সালে দেখা যায়। বর্তমানে এর প্রভাবে জেলায় নারকেলের ফলন অর্ধেকের বেশী কমে গেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল বিজ্ঞানী এসে সরোজমিনে বিষয়টি পর্যাবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন হোয়াইট ফ্লাইসহ ৬১টি প্রজাতির পোকা বিভিন্ন নারকেল গাছে আক্রমণ করেছে। বিশেষ করে নারকেলের পরে কলা এবং পেয়ারা গাছে এই পোকা অবস্থান করে। আমরা বর্তমানে কৃষকদেরকে ‘ইমিডা ক্লোরোফিড জাতীয়’ ঔষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। যেহেতু নারকেল গাছ অনেক লম্বা। এ কারনে ফুট পাম্পের মাধ্যমে স্প্রে করতে হয় এবং সব গাছে একসাথে করতে হয়। আসলে এটি ভালো ভাবে দমন করতে হলে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা দরকার। কিন্তু এই পোকা দমনে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার সঠিক গাইড লাইন এখন পর্যন্ত হয়নি। গাইড লাইন হলে এটি কার্যকর ভাবে দমন করা সম্ভব হবে।

(এসএকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২)