নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


শরতের শুভ্রতায় ভক্তের আহবানে এবার দেবী ধরাধামে আসছেন গজে চড়ে। দেবীর আগমনে যেন প্রকৃতির মাঝে বিরাজ করা অসুর সাজের বিদায় ঘন্টা। অসাম্প্রদায়িক এদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই অর্চনা যেন সকলের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ উপলক্ষে রঙ্গিন সাজে সেজেছে গ্রাম থেকে শহর যা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ভালোলাগা ও ভালো থাকার বার্তা। হেমন্তের স্নিগ্ধ করা ভালোলাগার দৃশ্য ভোরের ধানগাছের ডগায় শিশির জমে থাকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় হেমন্তের মায়াবী রুপের ঝলকে যেন ঠিক আরাধ্য দেবী মহামায়া দুর্গাকে। দেবী দুর্গার বিষয়ে জানতে হলে হিন্দু দর্শনে নিরাকার অসীম ঈশ্বরের তিনটি কাজ অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতি ও বিনাশের ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক প্রধান দেবতাদের সম্পর্কে জানতে হবে। তৃতীয় ধাপের বিনাশের দেবতা মহাদেব। সঙ্গে তার রয়েছে রুদ্ররুপিনী বিনাশিনী অসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা। 

দেবী দুর্গা বিশ্বের সকল বস্তুতে শক্তিরুপে সমভাবে অবস্থান করছেন। আর দেবীর এই শক্তিরুপের আরাধনা আমরা করে থাকি। ভক্তগণ অল্পজ্ঞান হেতু এবং উপাসনায় সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে সাকার পূজার্চনা করে থাকে। দেবী দুর্গা সনাতন ধর্মীয় রীতি ব্যবস্থায় যেন আশার প্রতীক হয়ে দোল খায় মানবের মাঝে। সনাতন হিন্দুধর্ম প্রাচীনতম ধর্মমত। সুদূর অতীতকাল থেকে বহু প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে আজও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রতি বছর মা আসেন ধরাধামে তার সন্তানদের আর্শীবাদ দিতে। দেবীকে ভক্তরা যে নামে যেভাবেই আরাধনা করে থাকে না কেন মা সেভাবেই সাড়া দেন ভক্তরে নিকট। ভক্তরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডেকে দেবীকে আরাধনা করে থাকেন। দুর্গার অনেক নামের মধ্যে একটি হচ্ছে শ্রী শ্রী চন্ডী। শ্রী শ্রী চন্ডী মার্কেন্ডেয় পুরানের অন্তর্গত। এতে তিনটি চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি চরিত্রের দ্বিতীয়টিতে মহিষাসুর বধ করেন।

ব্রহ্মার বরে শক্তিশালী হয়ে মহিষাসুর স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল জয় করে। অসুররা এই ত্রিলোকে রাজত্ব কায়েম করে। ফলে দেবগণ ও পৃথিবীর মানুষেরা অশান্তিতে পতিত হন। এমনকি অসুররা পূজা অর্চনা বন্ধ করে দেন। আর দেবতারা অসুরের কাছে পরাজিত হয়ে স্বর্গ থেকে বিতারিত হন। এ যেন অশান্ত পৃথিবীর এক প্রতিচ্ছবি।পরে দেবতারা মহাদেব ও ব্রহ্মার শরনাপন্ন হন। এই অশান্তি থেকে দেবতা ও মানুষদের পরিত্রাণ করার জন্য মা আর্ভিভূত হন। কারন সন্তান যখন বিপদে পড়ে তখন মা আঁচল পেতে সন্তানকে রক্ষা করেন। ত্রিদেব ও অন্যসব দেবতাদের তেজ থেকে সৃষ্টি হয় দেবী দুর্গার। কেউ মনে করছেন অশুভ শক্তি বিনাশ করার জন্য তিনি দশ হাত ধারিনী। দেবীকে ত্রিনয়না নামেও ডাকা হয়। কারন তিনি তিন চোখের অধিকারি। একেকটি চোখ ভিন্ন ভিন্ন বিষয় দর্শনের জন্য। বাম চোখে বাসনা, ডান চোখে কর্ম ও মাঝ চোখে জ্ঞানের চোখ।

দেবী দূর্গার যে রুপটিতে আমরা পূজা করে থাকি তা সমাজ ব্যবস্থার একটি বিশেষ ব্যবস্থা যা মনুষ্য শক্তিকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে থাকে সেই অসুর শক্তির বিরুদ্ধে। এ অসুর শক্তিকে পরাভূত করতে না পারলে সমাজ ব্যবস্থা অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। অসুর শক্তি বিনাশের জন্য আমরা দেবীর নিকট প্রার্থনা করে থাকি। যাতে সমাজ ও নিজের অসুর শক্তির বিনাশ হয়। আর দেবী এ অসুর শক্তিকে পারাজিত করে স্থাপন করে গেয়েছেন শান্তির জয়গান। অন্যদিকে দেবী দুর্গার মতো নারীরা যে সামলিয়ে থাকেন এই জগৎ সংসারকে এরই একটি প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই। কখনও মা কখনও স্ত্রী আবার কন্যা হিসেবে আর্বিভূত হয়ে থাকেন এই নারী। দেবীর হাতে প্রত্যেকটি অস্ত্র ভিন্ন ভিন্ন কাজে ধারণ করেছেন। দেবীর আরাধনা করে অন্তর থেকে কুপ্রকৃতির নাশ করে মন থেকে হিংসা, গ্লানি, ক্রোধ, রিপু থেকে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাই আরাধনার মূল কাজ। এ আরাধনা আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানব সভ্যতাকে আলোর পথে নিয়ে আসাটা অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত করা হয় দেবীকে যেন তার আলোয় আলোকিত হয় ধরাধাম।

দেব দেবীদের প্রদত্ত বিভিন্ন অস্ত্রের সহায়তায় বধ হয় অসুর শক্তির। পুনঃস্থাপিত হয় শান্তি। তাই বলা চলে মানুষের ভয় সর্বপ্রকারে পরিত্যাগ করিয়া আপনারা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করুন। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসে দুর হবে সকল অনাচার আর শান্তির বাতাসে সুশীতল হবে ধরণী। মুলত এই জগতের কর্মের গতি প্রকৃতি এবং বেঁচে থাকার প্রযোজনীয়তা অস্ত্রের মাধ্যমে জীব জগতের মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। পূজাকে কেন্দ্র করে মায়ের প্রার্থনার মাধ্যমে বধ হবে মানুষের মধ্য জাগ্রত অসুর শক্তির। শান্তির নিঃশ্বাস নিবে জগতের মানুষ। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক নৌকায় গমনের সময় নিয়ে যাবেন অশুভ শক্তিকে। কচি ধানের ক্ষেত যেমন পেঁকে সোনালী রং এ ভরে উঠে আনন্দে ভাসিয়ে দেয় কৃষককে। ঠিক তেমন জাগরিত হউক শুভ শক্তির যা মানুষের ক্লান্তিকে মুছে দিয়ে অল্প স্থায়িত্বের যৌবনা হেমন্তকালে দেবীর বর পেয়ে মানুষ্যকূল হউক শাপ মুক্ত তাই প্রার্থনা দেবীর চরণে।

আলোক সজ্জায় সজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি এই ধরাধাম আলোকিত হবে শুভকাজে এই প্রত্যাশা সকলের। পৃথিবী থেকে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে পরিচ্ছন্ন হউক পৃথিবী এই আরাধরাই দেবীর কাছে এবার। তবে ইত্যে সময়ে প্রায় প্রতিবছরই একটি বিশেস মহল সুন্দর একটি দেশকে পূজার সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে থাকে। যার ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে দেখা দেয় চরম উৎকন্ঠা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে মূর্তি ভাংচুরের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য সামাজিক সম্প্রীতির উদ্যোগ নিতে হবে পাশাপাশি সরকারকে সজাগ থাকতে হবে যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আনন্দের মধ্য দিয়ে তাদের এ বড় ধর্মীয় উৎসব পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চেয়েও সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন মনে রাখতে হবে প্রত্যেক ধর্মেই অন্যের ধর্মের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তাই অন্য ধর্মের মানুষ যেন তাদের আরাধনাটা সঠিকভাবে করেত পারে সেদিকে নজর দেওয়া সকলের কর্তব্য। এবং ভক্তদের মাথায় রাখতে হবে যে রঙ্গিন সাজ সজ্জার চেয়ে মাতৃ আরাধনাই আসল। যে আরাধনায় মা সন্তুষ্ট হয়ে তার সন্তানদের জন্য আর্শীবাদ প্রদান করবে। এবারের পূজা সকলের সম্মিলত প্রচেষ্টায় সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।