রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীন চার বছর মেয়াদী আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রোগাম বাস্তবায়নের জন্য যে সকল নির্দেশনা রয়েছে তার অধিকাংশই না মেনে বরাদ্দের টাকা হরিলুট করা হচ্ছে এমন চিত্র উঠে এসেছে সাতক্ষীরা  সদর উপজেলার ৭০টি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাংশ ঘুরে।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূযোগ হতে বঞ্চিত এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, যুবক ও বয়স্কদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে এ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। যদিও এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা, সাতক্ষীরা জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বাস্তবায়নকারি সংস্থা সাস এর লুটপাঠ বানিজ্যে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য লাঠে উঠতে বসেছে। এতে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জেলা প্রাথমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২৮৮জন। অথচ উপানুষ্ঠিক ৪২০টি বিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে ১২ হাজার ৬০০জনকে। এ বিপুল সংখ্যক ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী নিয়ে বিপাকে রয়েছেন শিক্ষা প্রশাসন। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ঝরেড় পড়া রোধে প্রশাসনের তৎপরতা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্যাচমেন্ট ভিত্তিক জরিপ, সরকারের উপবৃত্তি ও শিশু খাদ্য প্রদানসহ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের দেওয়া ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

শনিবার দুপুরে সরেজমিনে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাবুলিয়া (বালিয়াডাঙা) উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেয়ে জানা গেছে এলাকার লুৎফর রহমানের চায়ের দোকানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০/২২জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন শিক্ষক জ্যোস্না বেগম। ১৬ দিন পরে লুৎফর রহমান শৌচাগার ও গোবরগাদার পাশে তার জায়গায় টিনের চাল দিয়ে এক কক্ষের একটি ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাকে চার মাস বাবদ দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ২০০ টাকা। বালিয়াডাঙা গ্রামের ইসরাইল হোসেনের মেয়ে সাকিবা সুলতানা ও একই গ্রামের আক্তারুল ইসলামের মেয়ে সুমাইয়া খাতুন বাবুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে, নানার বাড়িতে থাকা আবুল হোসেন ওই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়লেও শিক্ষিকা জ্যোস্না বেগমের কথামত ভর্তি হয়েছেন এ উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এমন শিক্ষার্থী ১৭ জন বলে জানান ওই এলাকার সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। ওই সব ছাত্রদের অভিভাবকরা জানালেন, বিদ্যালয়ের মেঝেতে কার্পেট , শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম, মাসিক ১২০ টাকা উপবৃত্তি, টিফিনসহ ১৬টি ধরণের বরাদ্দ খাকলেও কেবলমাত্র খাতা বাই ও পেনসিল নিয়ে খুশী থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তবে পত্রিকায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এনজিও সাস এর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে মুখ না খোলার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।

বকচরা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যেয়ে দেখা গেছে রাস্তার পাশে শিক্ষিকা আয়েশা খাতুনের জমিতে বানানো হয়েছে পাকা স্কুল ঘর। তবে বকচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া রাকিবুল ইসলাম, সাজু ইসলাম, রোকেয়া খাতুন ও জুবায়েরসহ অনেকেই মাসে দেড়শত টাকা, স্কুলের পোশাক ও ব্যাগসহ নানান সরঞ্জাম পেয়েছে দাবি করলেও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কর্তৃপক্ষ যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেভাবেই ওরা বলছে।

পরানদহা কালিতলা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তাহছিম ও মেজবা জানায় তারা যথাক্রমে সোনারডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া আরো ১১ জন তাদের সহপাঠি হয়ে এ বিদ্যালয়ে পড়ছে। শিক্ষিকা মনিরা খাতুন স্বীকার না করলেও মাসিক ১২০ টাকা উপবৃত্তিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা না থাকায় ৩০ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজন আর বিদ্যারয়ে যায় না। আকবর আলী ঘর ভাড়া বাবদ ৮০০ টাকা মাসিক পেয়ে থাকেন।

পরানদহা কারিকরপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৮ জন শিক্ষার্থী থাকলেও আশামনি ও সিয়াম যথাক্রমে পরানদহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তাদের সহপাঠি রয়েছে ১০ জন। তবে শিক্ষিকা মাস্কুরা খাতুন কোন মন্তব্য না করেই বলেন, সব ঠিকঠাক চলছে। তবে শিক্ষার্থীদের যে মিথ্যা কথা শেখানো হয়েছে তা কথা বলার একপর্যায়ে স্পষ্ট হয়ে যায়। জমির মালিক সালাউদ্দিন বলেন, মাসিক ভাড়া পান এক হাজার টাকা।

হাজিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনাকারি কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে তারা কিভাবে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে এমন কথা জানতে চাইলে শিক্ষিকা তানিয়া খাতুন মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে বলেন, এতে সাংবাদিকদের সমস্যা কোথায় ? পরে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য বলেন, ত্র“টি বিচ্যুতি আছে। কি আর করার বলেন? বিদ্যালয়ের ঘর মালিক মোহাম্মদ আলী বলেন, ৮০০ টাকা করে তিনি ভাড়া পান। তবে মাস চারেক পেয়েছেন। সাস এর পক্ষে তার প্রকল্পের জেলা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, এত বড় কার্যক্রম, সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবে পারে।

সাতক্ষীরা জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কর্মকর্তা হীরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, কোন উপজেলায় কত বরাদ্দ তা নিদ্দিষ্ট করে বলা যাবে না। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, পেনসিল, চক, ব্লাকবোর্ড ছাড়া অন্য কোন খাতে বরাদ্দের টাকা অসেনি। ফলে সমস্যা তো থাকবেই। তবে শিক্ষার্থী ভর্তি করার ক্ষেত্রে অনিয়ম থাকলে ঢাকা থেকে ফিরে তদন্ত করবেন।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ০১, ২০২২)