মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : যেখানে পানি, সেখানেই জীবন,এটিই প্রতিষ্ঠিত সত্য সৃষ্টি থেকে। পানি মহান স্রষ্টার অপূর্ব এক নিয়ামত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পানি খুবই প্রয়োজনীয় জিনিস। আজকাল যুগের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক উপায়ে পানি সংগ্রহ হলেও চাবাগান ও প্রত্যন্ত অনেক অঞ্চলে এখনো সনাতন পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয় পানি। বিশেষ করে মৌলভীবাজারে চা বাগান এলাকা কিংবা পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করা অনেক মানুষ এখনো কুপের পানি দ্বারাই দৈনন্দিন সকল প্রয়োজন সম্পন্ন করেন। এই কুপ গুলো এক সময় খনন করা হতো। পানি উত্তোলনের আধুনিক সব পদ্ধতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে এখন আর আগের মতো পানি কুপ খুব একটা দেখা যায় না। অনেক বাড়িতে পরিত্যক্ত অবস্থায় এর কিছুটা অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ’’ইন্দারা হিসেবেই কুপকে ডাকা হয় বেশি। তবে এবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার প্রেমনগর চা বাগান এলাকায় সন্ধান মিলেছে রহস্যজনক এক পানির কুপের। কুপটির অবস্থান সদর উপজেলার প্রেমনগর চাবাগানের দেওরাছড়া সড়কের পাশের একটি ছড়ায়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুপটির রিং ভেদ করে উপরদিয়ে অবিরাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে ঝরনার মতো স্বচ্চ পানি। স্থানীয়দের কাছে এটি বম্পিং নামে পরিচিত। এটি খুদাই করা কোন কুপ নয়। কতিত আছে অর্ধ শতাব্দি পূর্বে বিদেশীরা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে এসে মৌলভীবাজারের প্রেমনগর ও দেওরাছড়া চাবাগানের বেশ কিছু স্থানে বিস্ফোরণ ঘটায়। ওই বিস্ফোরন মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করায় উপরিভাগে থাকা বালি ভেদ করে পরবর্তীতে ঝরনার মতো পানি উঠতে থাকে। সেসময় ওই পানি সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় ছড়ার পানির সাথে মিশে গিয়ে ছড়ার আর কুপের পানি একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তবে ওই পানি আর পরবর্তীতে বন্ধ হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর প্রেমনগর চাবাগানের ম্যানেজার সেসময় দেখলেন ওই পানি চা শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ হবে, শ্রমিকরাও নিরাপদ ভেবে পানি পান করছে এবং ওই পানি তাদের চাহিদাও মিটাচ্ছে। তাই তিনি শ্রমিকদের সুবিধার্তে ইট-সিমেন্টের তৈরি রিং বসিয়ে পানি সংরক্ষণের উদ্যেগ নেন।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়,বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্টি হওয়া পানির কুপটিকে চা শ্রমিকরা যুগযুগ ধরে বম্পিং নামে ডেকে আসছে। এই পানি যে শুধু চা শ্রমিকরা পান করছে তাই নয়, চলতি পথে অনেক মানুষ এখান থেকে পানি সংগ্রহ করেও নিয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড গরমেও এই কুপের পানি থাকে কোমল ঠান্ডা। শ্রমিকরা তীব্র গরমে চা পাতা সংগ্রহ করে যখন ফেরার সময় হয়, তখন চলতি পথে এই পানিই তাদের ক্লান্তি দূর করে কিছুটা প্রশান্তির পরশ ভুলিয়ে দেয়।

কুপটির পাশের জমিতে গরু ছড়াচ্ছেন প্রেমনগর চা বাগানের ৭৫ বছর বয়সী চা শ্রমিক নারায়ন পাশী। সেখানেই এই কুপটি কীভাবে সৃষ্টি হয় তা জানতে চাই তাঁর কাছে। তিনি জানান, বিদেশীরা প্রেমনগর ও দেওরাছড়া এলাকার বেশ কিছু জায়গায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নেমে বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে এরকম কুপ সৃষ্টি হয়ে পানি বের হয়নি। দেখতে সাদা রঙের ওই বিদেশীরা মোকামবাজার হয়ে দেওরাছড়া চাবাগান পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে। তবে সব জায়গায় পানি উঠেনি। তিনি বলেন, তার চোখের সামনেই তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ওই এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তিনি তাদের কাছ থেকেই জানতে পারেন বিস্ফোরণের ওই কারণ।

প্রেমনগর চা বাগানের চা শ্রমিক রাধা পাশী বলেন, আমার জন্মের বহু আগে থেকেই এই কুপ সৃষ্টি হয়েছে। বাবার কাছে জানতে পেরেছি বোমার বিস্ফোরণেই এর উৎপত্তি। বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুম, কোন সময়ই একটি মুহুর্তের জন্য এই কুপের পানি বন্ধ হয়নি।

স্বপন কুমার পাত্র নামের আরেক চা শ্রমিকের দাবী চব্বিশ ঘন্টাই পানি পরছে। অনেকে দূর দূরান্ত থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে এখানকার চা শ্রমিকরা সবাই এই কুপের পানি যুগযুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে।

অর্ধ শতাব্দী ধরে যে কুপের পানি পান করে আসছেন চা শ্রমিকরা তা কতটা নিরাপদ সে বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীজারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদুজ্জামান বলেন, কুপটির অবস্থান সম্পর্কে আমার জানা নেই, তবে এর পানিতে আর্সেনিকের পরিমান ও ভ্যকটেরিয়া আছে কী না তা আমাদের ল্যাবে পরীরক্ষা করলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, সরেজমিন লোক পাঠিয়ে পানির নমুনা সংগ্রহ করে দেখব এটি পান করার জন্য কতটা নিরাপদ।

(একে/এসপি/অক্টোবর ০৪, ২০২২)