মাজহারুল হক লিপু, মাগুরা : মাগুরা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়টির পূর্বে নাম ছিলো মহালক্ষী বালিকা বিদ্যালয়। এটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সেখানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছিলনা। সেকারণেই কিছু মানুষের বোধদয় হয় আরেকটি বালিকা বিদ্যালয় করা যায় কিনা। মাগুরা এজি একাডেমির প্রধান শিক্ষক খান জিয়াউল হক সে লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ফেব্রƒয়ারি মাসে মাগুরার কিছু গণ্যমান্য এবং বিদ্যোৎসাহী ব্যাক্তিকে মাগুরা সরকারি বিদ্যালয়ে আহবান করেন। যাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্যএডভোকেট আছাদুজ্জামান, সাইয়েদুল হকসহ বেশ কয়েকজন।  নেপথ্যে ভুমিকা রাখেন তৎকালীন মন্ত্রী এডভোকেট সোহরাব হোসেন। এডভোকেট আছাদুজ্জামানকে সভাপতি এবং খান জিয়াউল হককে সম্পাদক করে শুরু হয় স্কুলের কাজ। তখন সরকারি বালক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আনোয়ারা খাতুন। 

এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে মাগুরায় একটি বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং তার কার্যক্রম প্রাথমিক অবস্থায় মাগুরা একাডেমীতে পরিচালিত হবে। প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় এবি লুৎফে আলী বাবু মিয়াকে। উমা রাণী নামে গোয়ালখালীর একটি মেয়েকে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যমে স্কুলের যাত্রা শুরু করে স্কুলটি। সাথে সাথে কল্পনা ঘোষ, রোকেয়া সুলতানা, রওনক জাহান এবং রিজিয়া সুলতানাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় শিক্ষক হিসেবে। মাগুরা এজি একাডেমীতে মর্নিং শিফটে ক্লাশ শুরু হলো। খান জিয়াউল হক একাডেমীর শিক্ষকদেরকে অনুরোধ করেন বিনা পারিশ্রমিকে দুধমল্লিক স্কুলের ক্লাস নিতে। তাঁরাও সানন্দে রাজি হয়ে যান এ প্রস্তাবে। এজি একাডেমি স্কুল থেকে চক, ডাস্টার, খাতা এমনকি ঘন্টা দিয়েও সহযোগিতা করেন খান জিয়াউল হক।

রোকেয়া সুলতানার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, খান জিয়াউল হকের সাথে তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন।

খান জিয়াউল হক তার জীবনিতে উল্লেখ করেছেন, স্কুলের জন্য একখণ্ড জমি ক্রয়ের চেষ্টা করলেও অর্থের অভাবে সম্ভব হচ্ছিলনা। শহরের জিটি স্কুলের জায়গাটি ফাঁকা পড়ে ছিলো কিন্তু তা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আকবর বাহিনী প্রধান আকবর হোসেন মিয়াকে তার অসামান্য অবদানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আকবর সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীর স্বার্থে জায়গাটি সানন্দে ছেড়ে দিতে রাজি হন। সর্বসম্মতি ক্রমে এখানেই স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

১৯৭৪ সালে তৎকালীন মন্ত্রী, মাগুরার কৃতি সন্তান সোহরাব হোসেন স্কুলটির ভিত্তিপ্রস্তর উদঘাটন করেন। নির্মাণ কাজ শুরু হলেও টাকার অভাবে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছিলনা। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তেমন সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ান মাগুরার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দরবেশ আলী মিয়া। বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য তিনি শর্ত সাপেক্ষে দশ হাজার টাকা প্রদান করতে রাজি হন। শর্ত অনুযায়ি তার বাবার নামে বিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় দুধমল্লিক বালিকা বিদ্যালয়।

মিসেস কল্পনা ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিদ্যালয়ের ক্লাশ মাগুরা একাডেমীতেই চলতে থাকে। ১৯৭৪ সালের ১লা জানুয়ারী প্রথম বোর্ডের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৫ সালে প্রথম ব্যাচ এসএসসি পরীক্ষা দেয়। এসময় একাডেমীর শিক্ষকদের সুনামের কারণে ছাত্রীর সংখ্যা দুই শতাধিকে দাঁড়ায়। এদিকে ভবনের কাজও দ্রুত চলতে থাকে। ১৯৭৭ সালে বর্তমান ক্যাম্পাসে সেমিপাকা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নতুন ভবনে উঠে আসার পর বিশিষ্ট শিক্ষক সরোজনাথ মৌলিককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে তিনি স্কুল থেকে বেতন নিতেন না। যতদিন ছিলেন বিনা বেতনে কাজ করতেন। নতুন ভবনে কিছু নতুন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়। যার মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুস সোবহান, মনোয়ারা, আছিয়া খাতুন, অমরেশ সিকদার, আলাউদ্দীন মৌলভী, শচীন সরকার, যুথি প্রমূখের নাম উল্লেখখযোগ্য।

সরোজনাথ মৌলিক অবসর গ্রহণের পর আবু আল জাহির প্রধানশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে স্কুলটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

এই স্কুলের ছাত্রী সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল লায়লা জলি মাগুরার একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্কুলের ছাত্রী সংগীতশিল্পী হাসিয়ারা হাসি ১৯৮৩ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় লোক সঙ্গীতে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়া স্কুলের অসংখ্য ছাত্রী দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সুনাম অর্জন করেছেন।

(এম/এসপি/অক্টোবর ০৭, ২০২২)