মোহাম্মদ ইলিয়াছ


শান্তি রক্ষা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক চরিত্র। শান্তি রক্ষা করা বিষয়টি যেমন নিজ দেশ থেকে উৎসারিত, তেমনি করে যে কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক ফোরামে শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন প্রদান করে যাওয়া এর মৌলিক সিদ্ধান্ত। সে পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হতে পঞ্চাশ বছরে শান্তি বজায় রাখা এবং বিশ্বের অন্যান্য ক্ষেত্রে এ ধারাটি সঠিকভাবে অর্জিত হয়েছে। শান্তি অর্জন করতে হবে বা শান্তি বজায় রাখতে হবে- এমন নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ অর্জন করেছে একটি শান্তিকামী রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং অর্জিত এই অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে বাণিজ্য কূটনীতি প্রয়োগ ও বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে সারা বিশ্বে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি প্রণয়ন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মৌলিক ভিত্তি ছিল শান্তি। কিন্তু কী করে তার মাঝে এ ধারাটি জাগ্রত হলো? প্রশ্নটির উত্তরের তল পেতে গেলে তার রাজনৈতিক মনোজগৎ একটু বোঝা দরকার। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি রয়েছে; যাতে তিনি তার আত্মপরিচয় দিয়েছেন প্রথমে মানুষ এবং তারপর বাঙালি হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ''একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙ্গালি হিসাবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস মানুষের প্রতি উদার ভালোবাসা"।

ইতিহাসের দিকে ফিরে গেলে দেখতে পাই, বিশ্বের অন্যান্য মহান নেতাদের মতোই তিনি বিকশিত হয়েছিলেন তার চলমান সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং সে ভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দুটো আলাদা মুখোমুখি ব্লকের মাঝে ঠান্ডা লড়াইয়ের শুরু। এমন সময়ে তার নেতৃত্বের বিকাশ হয় এবং বাঙালিদের জাগরিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ লাভের জন্যে একটি স্বপ্ন জন্ম নিল তার মাঝে। স্বাভাবিকভাবেই ঠান্ডা লড়াইয়ের যে কোনো ব্লকে না জড়িয়ে, শান্তিবাদী ধারায় নিজেকে রাখাই ছিল তার জন্যে সঠিক নির্বাচন। এই যে বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক আবহ, সে পরিস্থিতিতে তার মনোভূমি গঠিত হয়েছিল শান্তির সপক্ষে। একই সঙ্গে দৃশ্যমানভাবে তিনি লড়াই করছিলেন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। লড়াইটা ছিল শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে। ফলে, তার রাজনৈতিক আবেগটি মানবতার সঙ্গে হয়েছিল সংযুক্ত সুদৃঢ়রূপে।

বঙ্গবন্ধু শান্তির প্রতি সবসময় অত্যন্ত আকৃষ্ট ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এটি তার মনের একেবারেই মূল ভিত্তি। বৈশ্বিক ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সচেতন। ১৯৫২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন তিনি। সেখানে বিভিন্ন দেশের শান্তি আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ হয়। তিনি তার বই, আমার দেখা নয়াচীনে (দ্য নিউ চায়না যেমন আমি দেখেছি) অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ''রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই।"
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে, ২৬ অক্টোবর ১৯৭০ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে পাকিস্তানের রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রনীতির ওপর আলোকপাত করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন- আজ বিশ্বে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, তাতে আমরা কোনোভাবেই জড়িত নই। -এ জন্যে আমাদেরকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। সংবিধানে বিশ্ব সমাজের জন্য বঙ্গবন্ধুর শান্তি চেতনা প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়'।
সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ-এ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি বর্ণিত হয়েছে; ২৫। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র; (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপেনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।

১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, 'একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে মুক্ত ও সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকারের জন্য বাঙ্গালী জাতি বহু শতাব্দী ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। তারা চেয়েছে বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করতে।

জাতিসংঘ সনদে যে মহান আদর্শের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের জনগণের আদর্শ এবং এ আদর্শের জন্য তারা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এমন এক বিশ্ব-ব্যবস্থা গঠনে বাঙ্গালী জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্খা প্রতিফলিত হবে এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখো লাখো শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে। আমাদের জন্য বিশেষ সৌভাগ্যের কথা, বাংলাদেশ এমন এক সময়ে জাতিসংঘে প্রবেশ করেছে- যখন এই পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেছেন এমন এক মহান ব্যক্তি যিনি ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তি সংগ্রামী।''

শান্তি প্রক্রিয়ার যে ধারাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু করেছিলেন, সেটি অনুসরণ করেছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া অন্যান্য শাসকও। সেসব সামরিক ও বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্র শাসন করতে জনতার প্রতি যদিও নানাভাবে অনেক অবিচার করেছে, কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক ভিত্তিটিকে বদল করেনি। অবশ্য পররাষ্ট্র নীতির সার্বিক সফলতা ও শান্তি রক্ষার বিষয়টি অনেক বেশি জোরালোভাবে এগিয়ে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি, তার বড় কন্যা দেশরত্ন জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলা যায়, শান্তি বজায় রাখা ও অর্জনের এ ধারাটি উচ্চশিখরে নিয়ে গেছেন তিনি সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি বজায় রাখার একই সুর বেজে উঠেছে। ৩০ মার্চ, ২০১৮-এ, তিনি টুইট করেছিলেন, ''আমি শান্তিতে বিশ্বাস করি। একমাত্র শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।" ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি বলেছেন, ''আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার কল্পনা করি।''

সারা বিশ্ব যখন জলবায়ু ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তখন বাংলাদেশের ক্ষতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পত্রিকা গার্ডিয়ানে কলাম লিখে সকলকে দেখিয়েছেন, জলবায়ু সংকটের কারণে বাংলাদেশের কত অংশ ডুবে আছে। তখন থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা একটি অন্যতম ইস্যু এবং এই সংকট শুধু বাংলাদেশেরই নয়, এটি বৈশ্বিক একটি সংকটও বটে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ সংকট কাটাতে বৈশ্বিক কৌশল প্রণয়নেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন দৃষ্টান্তমূলকভাবে।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি একুশ শতকের উপযোগী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্ধারিত এবং বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবোচিত পররাষ্ট্র নীতিরই যোগফল। তিনি জাতিসংঘসহ একাধিক বৈশ্বিক ফোরামে বলেছেন, আমাদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করা নয়; বরং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দৃশ্যপটের যে পরিবর্তন হচ্ছে তা মোকাবিলা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শুধু বাংলাদেশকেই নয়, বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছেন। আঞ্চলিক ইস্যুতেও প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে পথ দেখাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, নিজে একা উন্নতি করলে উন্নয়ন বলা যাবে না, সবার একসঙ্গে উন্নতি ঘটলেই উন্নয়ন বলা যাবে।'

সকলেই লক্ষ্য করছি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি স্ট্র্যাটেজিক প্লেয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর- যেমন বিমসটেক, বিসিআইএম, বিআরআই, বিবিআইএনের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং এর প্রভাব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও পড়ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে একটি কার্যকর ভারসাম্যের কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে চীন-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, চীন-জাপান এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মাঝেও ওই সব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে কৌশলগত সামরিক সহযোগিতারও সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে সফলভাবে। ফলাফলরূপে বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনৈতিক শক্তির উন্নত দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য নিরাপত্তা, শান্তিচুক্তি, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণী বিজয়, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতিতে উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ প্রভূত সাফল্য পেয়েছে। চীন, ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টে আসছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এটি ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে অর্থনীতিবিদগণ আশা করছে। শুধু ২০১৮-১৯ সালে ভারতের সঙ্গে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

এমনটা ঘটছে সঠিক নেতৃত্বের কারণে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত করেছে এবং করে চলেছে বিশ্বজুড়ে চলমান বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই। সুতরাং প্রাপ্ত ফসল হলো, বাংলাদেশের উত্থান ঘটছে অভূতপূর্বরূপে এবং তার আঙ্গিকে বিশ্বের অনেকেই আজ বাংলাদেশকে এমার্জিং পাওয়ার হিসেবে বিচেনা করছে। সফল কূটনৈতিক অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক অর্জনকে একটি বিশেষ উচ্চ স্তরে নিয়ে গেছে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির দেহ হচ্ছে বর্ধিত।

জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) সভায় বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতার স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হয় ১৫ মার্চ ২০০৮ সালে। ২০০০ সালে শুরু হওয়া মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এমডিজি অর্জনের সফলতার পরেই জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজি অর্জনের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে বেশিরভাগই অর্জন করেছে বাংলাদেশ এবং ২০৩০ সালের আগেই এসডিজির পূর্ণ বাস্তবায়নে সক্ষমতা আসবে বলে বিশ্বাস করা যায়।

এতসব সফলতার স্বীকৃতিও কম নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৩৭টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেওয়া হয়। এর মধ্যে গণতন্ত্রের মানসকন্যা থেকে শুরু করে মাদার অব হিউম্যানিটি, ইউনেস্কো থেকে ১৯৯৮ সালে 'হুপে-বোয়ানি' শান্তি পুরস্কার, চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি এখন বাংলাদেশের ঝুলিতে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও রাজনীতির সুযোগ্য অধিকারী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সাম্প্রতি জাতিসংঘের সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসা উপলক্ষে আজকে যে অত্যন্ত উপযোগী বিষয় নিয়ে ভোরের পাতা যে আলোচনার আয়োজন করেছে সেজন্য আমি ভোরের পাতার সংলাপের কলাকুশলীদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং আরও কৃতজ্ঞতা জানাই আমাকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। আজকের যে বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়েছে জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রী; এযেনো সেই বিষয়বস্তুর প্রতিধ্বনি যেটা আমরা নির্ধারণ করেছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য যে বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ব বন্ধু। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পথ অতিক্রম করে আমাদের জন্য আগামীর পথ রেখে গিয়েছেন, যে পথে তিনি বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ব বন্ধু হয়েছেন সেই পথে অত্যন্ত সফলভাবে লক্ষ্য করে তার স্বীয়গুণে সে পথ মেনে জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্রমাগত নিজেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের নেতৃত্ব থেকে বিশ্ব নেতৃত্বে, দক্ষিণ এসিয়ার আঞ্চলিক থেকে ক্রমাগত তিনি বিশ্ব নেত্রীতে রূপান্তরিত হচ্ছেন। যে হাত দোলনা দোলায় সে হাত বিশ্বকে শাসন করে।

আমার মনে হয় যে, সংক্ষিপ্তভাবে যদি জননেত্রী শেখ হাসিনার যে কর্মকাণ্ডের কিঞ্চিৎ অংশ তুলে ধরতে চাই, তাহলে এই প্রবাদের কোন বিকল্প নেই। আক্ষরিক অর্থে এবং অন্যান্য ভাবার্থে এই প্রবাদটা তার সঙ্গে একেবারেই উপযুক্ত। তিনি প্রথমে একজন মা, তারপরে তিনি যেভাবে নিজের সন্তানদেরকে লালন পালন করে দেশসহ বর্তমানে বিশ্ব শাসন করছেন সেটা আসলে দীর্ঘ আলোচনা ও গবেষণার বিষয়। মানবতার সেবাই নিজেকে আত্মনিযুক্ত করবার যে চেষ্টা সেটা তার দুই সন্তানের ভেতরেই রয়েছে। তিনি একজন সফল মা এবং রত্নগর্ভাও বটে। জননেত্রী শেখ হাসিনা গণমানুষের নেত্রী হিসেবে দেশের স্বার্থে বরাবরই আপোষহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। তিনি বিদেশি দাতা সংস্থার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ঘোষণা দিয়েছিলেন পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশিরা যতো ষড়যন্ত্রই করুন না কেনো, বাংলাদেশ নিজের টাকাতেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। তাঁর দৃঢ় মনোবলেই নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুর কন্যার জন্যেই সম্ভবপর হয়েছে। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া মোকাবেলা করেই নির্মাণ করছেন পদ্মা সেতু।

বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে যে, বাংলাদেশের মতো দেশ বিশাল পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। যে বাংলাদেশ ছিল একসময় অবহেলিত, দারিদ্র্যপীড়িত; যে বাংলাদেশকে নিয়ে পশ্চিমা-বিশ্ব উপহাস করত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে; প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সুদক্ষ, সৃজনশীল ও সাহসী নেতৃত্বের ফলে; সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোলমডেল। যে বাংলাদেশ এক সময় পরিচিতি সমস্যায় ভুগতো, সেই বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁরই কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার কারণে। শেখ মুজিব যেমন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছেন ঠিক তেমনি তার কন্যা শেখ হাসিনা জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। তার এই বিকাস সমুন্নত থাকুক।

লেখক : সহকারী পরিচালক (প্রশাসন), বেসরকারি অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।