আবীর আহাদ


বিগত দু'বছর পূর্বে সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্যে বিনামূল্যে যে "বীর নিবাস" প্রকল্প অনুমোদন করেছিলেন, মাঝখানে একটি বছর অতিবাহিত হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা ও হীনম্মন্যতার কারণে তেমন কোনো কার্যকারিতা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখছে না! অপরদিকে এও খবর পাওয়া যাচ্ছে, বীর নিবাস নির্মাণের সাথে জড়িতরা নিম্নমানের মালামাল দিয়ে কোনো রকমের একটা বাড়ি দাঁড় করলেও তা কিছু দিনের মধ্যেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বলা চলে বীর নিবাস বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর আবাসে পরিণত হচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, বীর নিবাসের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০% এর কাজ হচ্ছে, বাকি অর্থ যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পেটে। তাই বিনামূল্যের করুণানির্ভর ও ঠিকাদার-প্রকৌশলীদের জোড়াতালির বীর নিবাস নয় প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা কেটে নেয়ার শর্তে বিনাসুদে ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান করা হলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই সরকারের বীরনিবাস প্রকল্পের নকশা অনুসরণ করে নিজেরাই বাড়ি নির্মাণ করে নিতে পারবেন। এতে করে বাড়িগুলো তারা ভালোভাবে নির্মাণ করবেন। ফলে কারো দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না।

আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, গত বছর ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি করে দেয়া হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুর ঘোষণা দেয়ার পর উপজেলায় উপজেলায় যে বাণিজ্যিক ধান্দা শুরু হয়েছিলো, সেটাও ছিলো মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নির্মম এক তামাশা! ছিলো অর্থের হোলিখেলা। দেশের সিংহভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন। এ অবস্থায় ঐ তথাকথিত ১৪/৩০ হাজার তথাকথিত বীর নিবাস কারা কীভাবে কখন পাবেন তা আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশেরই নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই। এ অবস্থায় বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে সেজন্য কতোটি বছর অতিবাহিত হবে এবং ততোদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কিনা তা কি কেউ বলতে পারবেন? এ-ব্যতীত প্রত্যেক উপজেলায় প্রকৃতই গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বাড়ি পাচ্ছেন তারও কী কোনো নিশ্চয়তা আছে? প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণীর প্রতারকচক্র স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে পর্দার অন্তরালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছে! এ-প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃতই গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়, অধিকাংশ বাড়িগুলো পেয়েছে টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের প্রভাবশালী ও অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে তথাকথিত সরকারি বীর নিবাস প্রাপকদের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছিলো তার মধ্যে উপরোক্ত আশংকার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। ফলে বীর নিবাস কোনো বাস্তবসম্মত প্রকল্প নয়। এমতাবস্থায় বিনামূল্যের তথাকথিত বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গৃহঋণ প্রদান করাই শ্রেয়।

সুতরাং যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিতকালের মধ্যেই করতে হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর তেমন বেশি দিন বাঁচবেন না। এছাড়া তথাকথিত ৩০/১৪ হাজার বাড়ি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে চরম রেষারেষি ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সব মুক্তিযোদ্ধাই তো এ-সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী। সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ ছোটো বা কেউ বড়ো মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই। সবাই মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি দিতে হলে সবাইকে একসাথে দিন, অন্যথায় এ অবাস্তব জগাখিচুড়ি ও হানাহানিপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিন। যাদেরকে বীর নিবাস করে দেয়া হচ্ছে, তাদের বাদ দিয়ে অন্যান্য সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন। যার প্রয়োজন তিনি ঋণ নেবেন অথবা নেবেন না। এতে সবাই একটি সান্ত্বনা পাবে। কোনো মন খারাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, হবে না কোনো হানাহানি। অপরদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপীও হবে না। কারণ তারা ঋণ নেবে তাদের ভাতার বিপরীতে যে ভাতাটি সরকারেরই হাতের মুঠোয় ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং সরকারের কাছে আমার আবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে, তাদের মনে ব্যথা না দিয়ে অবিলম্বে বিনামূল্যের বীর নিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে বীর নিবাস নির্মাণের নকশা অনুসরণ সাপেক্ষে সবার জন্য গৃহঋণের সুব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এতে চিরবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের বেদনার্ত বুকে একটা অপার শান্তি ও সান্ত্বনা বয়ে আনবে।

এখানে সংগতকারণে উল্লেখ্য যে, আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে যে ৮ দফার স্মারকলিপি প্রদান করেছি, সেই স্মারকলিপিতে বিনাসুদে ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণের দাবি করেছি। সেসম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কিছুদিন পূর্বে আমাদের যে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তিনি বলেছিলেন যে, সরকার ৩% সুদে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা সেটিকে বিনাসুদে ২৫ লক্ষ টাকা প্রদানের দাবি জানালে মন্ত্রী মহোদয় সরকারকে বলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এ বিষয়ে জরুরীভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আমরা সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধার সংসদ।