শিতাংশু গুহ


বাংলাদেশে হিন্দু কমছে, অথচ দূর্গাপূজা বাড়ছে কেন? নিউইয়র্কে জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার-এর সাথে আমার এ নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়। সচরাচর আমি অফিস থেকে বাড়ী ফেরার পথে বা রতন তালুকদার বাড়ী থেকে জ্যাকসন হাইট্স যাওয়ার পথে আমরা প্রায়শ: বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলি, তাতে নিউইয়র্ক, বাংলাদেশ, রাজনীতি বা বিশ্ব সবই থাকে। সকল বিষয়ে আমরা একমত তা নয়, তবে হিন্দু কমছে অথচ পূজা বাড়ার বিষয়ে আমরা  আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পৌঁছেছি যে, ধর্ম বা ভক্তি নয়, হিন্দুদের মধ্যে আত্মকলহ এর মুখ্য কারণ। দৃষ্টান্ত হিসাবে  নিউইয়র্কের পূজা সমিতি’র প্রসঙ্গ এসেছে। ১৯৯০ সালে পূজা সমিতি প্রথম পূজা করে, ১৯৯১ সালে তা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং এর কারণ ছিলো নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল। বাংলাদেশেও একই চিত্র। এক বছর পাঁচজন মিলে পূজা করলে পরের বছর তাঁরা বিভক্ত হয়ে দু’টি পূজা করে। তাই হিন্দু কমলেও পূজা বাড়ছে।

আমাদের আলোচনার সাথে কাউকে একমত হতে হবে তা নয়, কিন্তু কথা সত্য। দেশে পূজা বেড়ে যাওয়ার আরো কিছু কারণ আছে, যেমন সরকার কিছু চাল-চিনি-বা নগদ ক্যাশ ভর্তুকি দেন্, বিশেষত: মফঃস্বলে পূজা বাড়ার এটিও একটি কারণ। অবাক কান্ড যে পশ্চিমবঙ্গের চিত্র এথেকে ব্যতিক্রম নয়? বাংলাদেশে দূর্গাপূজার সংখ্যা বাড়ছে, এতে কি হিন্দুদের খুব উপকার হচ্ছে? হলে সেটি কি? আমার ধারণা তা হচ্ছেনা, বরং রেষারেষি বাড়ছে। একদা ঢাকেশ্বরী পূজার সাথে পুরানো ঢাকা এবং মহাখালী দুর্গাপূজার একটি অলিখিত বৈরিতা ছিলো। লোকে বলে, এখন ঢাকেশ্বরীর সাথে উত্তরার প্রতিযোগিতা চলমান। উত্তরা বড়লোকের পূজা হিসাবে ইতিমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্যাত্মিকভাবে পূজা করার ধর্মীয় দিক হয়তো আছে, কিন্তু বারোয়ারী পূজার বিবিধ থিম, ব্যাপক আলোকসজ্জা, ব্যয়বহুল প্যান্ডেল, ডিজে, নাচ-গান, হৈহুল্লুড় করে অর্থ অপচয়ে হিন্দুদের কি উপকার হচ্ছে? পূজা কমিটি’র ইয়ং-রা কি সিনিয়রদের থেকে চাকুরী বা ব্যবসা’র কোন যোগসূত্র পাচ্ছেন?

সামাজিক মাধ্যমে দেখলাম ভ‌বের বাজার, পার্বতীপুর, দিনাজপুরে একটি পূজা মণ্ডপের প্রধান ফটকটি নির্মিত হয়েছে পঁচিশ লক্ষ টাকা ব্যয় করে। আমাকে উত্তরা পূজার কোটি কোটি টাকা খরচের গল্প শুনিয়েছেন এক সুহৃদ। বাংলাদেশে এবার পূজার সংখ্যা দেখলাম +৪০হাজার। দেশে পূজায় মোট কত টাকা খরচ হয়, এমন একটি পরিসংখ্যান মিডিয়া কখনো করেছে বলে শুনিনি। অর্থের ব্যাপক অপচয় হচ্ছে, তা বলা বাহুল্য। আমি বলছি না যে পূজা কমাতে হবে, বলছি প্রতিটি পূজা কমিটি জাতিকে কি দিচ্ছেন? জাতি অনেক বিশাল ব্যাপার, হিন্দু কমিউনিটিকে কি দিচ্ছেন? তাঁরা সামাজিক উন্নয়নে কি ভূমিকা রাখছেন? এই চল্লিশ হাজার পূজা মণ্ডপ যদি একটি করে হিন্দু পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার কর্মসূচী নিতো তাহলে বছরে ৪০ হাজার পরিবার বেঁচে যেতো। কোটি কোটি বা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ থেকে সামান্য কিছু বাঁচিয়ে এ কাজটি করা যায়।

অনেক মণ্ডপ পূজায় শাড়ি-লুঙ্গী বিতরণ করেন, এটি ভালো উদ্যোগ, এরচেয়ে ভালো হয় যদি ওই টাকা দিয়ে একটি বা দশটি পরিবারকে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়, অথবা একটি শিক্ষিত ছেলেকে একটি কম্পিউটার কিনে দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। সবগুলো পূজা কমিটি যদি এ বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করেন, তবে দশ বছর পর সমাজের চেহারাটা পাল্টে যাবে। নিউইয়র্কে এবার ২৪/২৫টি পূজা হয়েছে। প্রতিটি কমিটি যদি দেশে একটি করে পরিবারকে স্বাবলমী করার উদ্যোগ নিতো, তাহলে ২৫টি পরিবার বেঁচে যেতো, এবং এজন্যে খরচ হতো অতি সামান্য, নেতারা বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে পারেন। এমনিতে হিন্দুরা যথেষ্ট আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, এঁরা ভিক্ষাবৃত্তি করেনা। আপনাদের সামান্য সহায়তা এদের আত্মনির্ভর হতে উৎসাহী করবে। আমরা সবাই কমবেশি গরিব-দু:খিকে সহায়তা করে থাকি, একশ’ জনকে একশ’টি লুঙ্গী বা শাড়ি না দিয়ে সেই টাকা দিয়ে ২/৩টি পরিবারকে রিকশা কিনে দিলে ২/৩টি পরিবার স্বাবলম্বী হবে, সমাজে হাত-পাতার লোক কমবে, খেটে খাওয়ার মানুষ বাড়বে, এতে সবার লাভ, দেশের লাভ। পূজা ছাড়াও যাদের একটু পয়সা আছে, বা যারা মানুষকে সহায়তা করতে চান, তাঁরা এটি ভেবে দেখতে পারেন। অর্থাৎ দান নয়, একটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করে দেয়া।

পূজা বাড়ুক, সাথে মানুষের কষ্ট কমুক। এমনিতে পূজায় সবাই প্রসাদ পায়, গরিবরাও হয়তো পাঁচদিন প্রসাদ খেয়েই বাঁচে, এই গরিবদের মধ্যে থেকে ক’জনকে স্বাবলম্বী করা গেলে পূজা বাড়ার স্বার্থকতা বাড়ে। উত্তরার পূজায় কোটি কোটি খরচ হয়, এদের কাউকে কাউকে আমি চিনি, তাঁরা ভালো। তবে খরচ কমিয়ে দু’চারটি হিন্দু পরিবারকে স্বাবলম্বী করলে ভালো হয়। মহানগর পূজা কমিটি বা দেশের সকল পূজা মণ্ডপের জন্যে একই কথা প্রযোজ্য। দেশে অনেক জীর্ণশীর্ণ মন্দির আছে, পূজা কমিটিগুলো কিছু টাকা বাঁচিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিতে পারেন। বলছি, গঠনমূলক কিছু করুন, কমিউনিটিকে বাঁচিয়ে তুলুন। কমিউনিটি বাঁচলে পূজা বাঁচবে। বারোয়ারী পূজার মুখ্য বার্তা জনসংযোগ বাড়ান এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা, সেটি করা প্রয়োজন। বিশ্বাস করুন, দেশের ৪০ হাজার পূজা কমিটি যদি তাদের এলাকার হিন্দুদের পাশে দাঁড়ায়, বিপদে-আপদে এগিয়ে যায়, মন্দিরে সিসি ক্যামেরা লাগাতে সহায়তা করে তাহলে দেশে হিন্দু অত্যাচার কমতে বাধ্য। শুধু সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে, পূজা কমিটিগুলো হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন।

বাংলাদেশে সমস্যাগ্রস্থ হিন্দু সমাজের অন্তত: কিছুটা উপকার হলেও পূজার সংখ্যা বাড়ার সার্থকতা থাকবে। বাংলাদেশে মূর্তিভাঙ্গা, মন্দির আক্রমন, সংখ্যালুঘু নির্যাতন চলছেই, ৪০হাজার কমিটি থেকে মাত্র ৫জন করে লোক নিয়ে ঢাকায় একটি বড়সড় প্রতিবাদ করলে ২লক্ষ (৫x ৪০,০০০) মানুষ হবার কথা, কখনো কি হয়েছে? পূজা বাড়ুক, সাথে অধিকার আদায়ের প্রত্যয় বাড়ুক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতে বারোয়ারী পূজায় প্রতিযোগিতা ছিলো, এখনো আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে; তবে প্রতিযোগিতাটা হোক কোন কমিটি কতগুলো পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে পেরেছে, তা নিয়ে; কোন কমিটি ক’টি মন্দির সংস্কার করেছে, তা নিয়ে; কোন কমিটি’র ক’জন ছাত্র-ছাত্রীকে সাহায্য করেছে, বা ক’টি দু:স্থ মানুষের সেবা করেছে; বা অসহায় মেয়ে’র বিয়ে দিয়েছে, তা নিয়ে। বাংলাদেশে হিন্দুদের স্বার্থে, বা টিকে থাকার স্বার্থে বিদেশে এবং বিশেষত: দেশে সকল পূজা কমিটি, সকল মন্দির বা ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, হিন্দু থাকলেই পূজা থাকবে; হিন্দু বাচঁলেই ধর্ম বাঁচবে, মন্দির থাকবে; তাই, হিন্দু’র সংখ্যা বাড়ুক, পূজাও বাড়ুক। ফেইসবুকে আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘দেশে হিন্দু কমছে, পূজা বাড়ছে কেন’? প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছেন, অনৈক্য, রেষারেষি, উপদল, সংঘ, উপসংঘ বা কেউ কাউকে সহ্য করতে না পারা এর মূল কারণ।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী